• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
দ্বিতীয় দিনও বিক্ষোভ অচল রাজপথ

বাসচাপায় নিহত রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া আক্তার মিম ও আব্দুল কারিম সজীব

সংগৃহীত ছবি

দুর্ঘটনা

বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত

দ্বিতীয় দিনও বিক্ষোভ অচল রাজপথ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩১ জুলাই ২০১৮

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে দুই বাসের রেষারেষিতে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত ও বেশ কয়েকজন আহতের ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সোমবারও বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। এদিন রাজধানীর অন্যান্য

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে। এর ফলে নগরীর বেশ কয়েকটি সড়কে যান চলাচল কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে। আন্দোলনের কারণে কয়েক ঘণ্টা বন্ধ ছিল রেল যোগাযোগও। পরে পুলিশ ধাওয়া ও পিটিয়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে।

এদিন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভকালে রমিজ উদ্দিন কলেজের ছাত্র সাইদুল ইসলাম আপন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ৯ দফা দাবি তুলে ধরে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এসব দাবি মেনে নিয়ে ৭ দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন না হলে আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে আবারো আন্দোলন চলবে বলে জানায় সে। ৯ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- বেপরোয়া ড্রাইভারকে ফাঁসি ও এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন, নৌপরিবহনমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে, শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে তাদের বাসে তুলতে হবে, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়ার ব্যবস্থা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবে না, বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না।

বাসচাপায় নিহতের ঘটনায় এদিন সকালে শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে বাধা দেয় পুলিশ। সকাল ১০টার দিকে তারা রমিজ উদ্দিন কলেজের সামনের রাস্তায় মানববন্ধনে দাঁড়াতে যায়। কিন্তু পুলিশের বাধায় সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে রাস্তা অরবোধ করতে যায়। পুলিশ সেখান থেকেও তাদের সরিয়ে দেয়। এ সময় উত্তরাগামী বাস থামিয়ে জোর করে শিক্ষার্থীদের তাতে তুলে দিতে থাকে পুলিশ। এর মধ্যেই বেলা পৌনে ১১টার দিকে হাজারখানেক শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে রমিজ উদ্দিন কলেজের সামনের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বসে পড়ে। এ সময় পুলিশ সরে গিয়ে রাস্তার পাশে অবস্থান নেয়।

বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিমানবন্দর সড়কের দুই দিকই বন্ধ করে দেয়। ‘বিচার চাই, বিচার চাই’, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই’ বলে স্লোগান দেয় তারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজ, কুর্মিটোলা বিএএফ শাহীন কলেজ, গুলশান কমার্স কলেজ, গুলশান ডিগ্রি কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, ঢাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ, বনানী বিদ্যানিকেতন, ভাষানটেক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বিএফ শাহীন কলেজ তেজগাঁও, বাংলা কলেজ, সরকারি বিজ্ঞান কলেজসহ ক্যান্টনমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা।

অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করতে আসছি। কিন্তু পুলিশ আমাদের জোর করে সরিয়ে দিচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে। বলছে থানায় নিয়ে পেটানো হবে, রাজনীতির মামলা দেবে। এসব বলে ভয় দেখাচ্ছে। জোর করে বাসে তুলে দিচ্ছে।’ একপর্যায়ে একটি রায়টকার, এপিসি ও জলকামান নিয়ে শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। এতে শিক্ষার্থীরা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেগুলোকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়তে থাকে। পরে সেনা কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে এপিসি ও রায়টকার পিছিয়ে গেলে শান্ত হয় শিক্ষার্থীরা।

একই সময় রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় ও মিরপুর সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, আইডিয়াল কলেজ, সিটি কলেজ, রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, ঢাকা কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফ পাবলিক কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজসহ আশপাশের কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় ধানমন্ডিতে বিক্ষোভকালে দুই শিক্ষার্থী আহত হয়। ধানমণ্ডি থানার ওসি আবদুল লতিফ বলেন, ‘দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা। এ সময় তারা বাসের চালক ও হেলপারের ফাঁসির দাবি জানায়।’

বাড্ডায় প্রগতি সরণি সড়কে গুলশান কমার্স কলেজ, গুলশান ডিগ্রি কলেজ, মাইলস্টোন কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শত শত শিক্ষার্থী সড়কপথে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে মানববন্ধন করে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অবরোধ কর্মসূচি থেকে পাঁচজনকে পুলিশ আটক করেছে। তবে গুলশান বিভাগের ডিসি মোশতাক আহমেদের দাবি, কাউকে আটক করা হয়নি।

বেলা ১টার দিকে শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় বিচারের আশ্বাস দিয়ে মানবিক কারণে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ নূরুন্নাহার ইয়াসমিন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। বিকাল ৪টার দিকে পুলিশ ও র্যাব শিক্ষার্থীদের ধাওয়া ও পিটুনি দিয়ে সরিয়ে দিলে বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল শুরু হয়। এ সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি কাজী সাহান হক বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আজ (সোমবার) আবারো রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করে। বিক্ষোভ করে, যানবাহন ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। জানমালের নিরাপত্তা ও রাস্তায় গণপরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ইট-পাটকেল মারতে মারতে শেওড়ার দিকে সরে যায়। এরপর বিকাল ৪টা ১২ মিনিটে যানচলাচল শুরু হয়।’

রাজধানীর ব্যস্ততম দুটি সড়ক শিক্ষার্থীরা অবরোধ করায় এদিন ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। দুই সড়কের যানজট অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় যাত্রীদের অশেষ ভোগান্তি পোহাতে হয়। নিউমার্কেট থেকে মিরপুর, শাহবাগ থেকে ধানমণ্ডি, বনানী থেকে উত্তরা, উত্তরা থেকে বনানী ও মিরপুর, কালশী হয়ে উত্তরা যাওয়ার সড়কগুলো অচল হয়ে পড়ে। এসব রাস্তার উভয় প্রান্তে তৈরি হয় যানজট। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় গাজীপুর এবং দেশের উত্তর-পূর্ব অংশ থেকে আসা বিভিন্ন পরিবহনের ঢাকা প্রবেশ। দীর্ঘ যানজট পৌঁছে যায় গাজীপুরের কলেজগেট এলাকা পর্যন্ত। অনেককে জরুরি কাজ থাকায় হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। তবে হজ ও অন্যান্য বিদেশগামী যাত্রী এবং অ্যাম্বুলেন্সের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তাদের যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে দেওয়া হয়।

এদিন একপর্যায়ে ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনের কাছে রেললাইনের উপর বসে পড়ে শিক্ষার্থীরা। ফলে রেল চলাচল কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনের ম্যানেজার মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘দুপুর দেড়টার দিকে শিক্ষার্থীরা রেলস্টেশনের কাছে শেওড়া এলাকায় রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে তাৎক্ষণিক রেল যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়। পরে রেললাইন অবরোধ প্রত্যাহার করলে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ চালু হয়।’

এদিকে র্যাব-১ জানিয়েছে, গত রোববার রাতে মিরপুর থেকে জাবালে নূর পরিবহনের দুই চালক ও তাদের দুই সহকারীকে আটক করা হয়েছে। গতকাল সোমবার র্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আটক দুই বাসচালক হলো সোহাগ ও যুবায়ের।

গত রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৯২৯৭ ও ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৭৬৫৭) মিরপুরের দিক থেকে বিমানবন্দর সড়কের দিকে আসার পথে ফ্লাইওভারেই একে অপরকে ওভারটেক করে পাল্লা দিয়ে নিচে নামছিল। উড়াল সড়কের গোড়ায় রমিজ উদ্দিন কলেজের কয়েক শিক্ষার্থী বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল, কয়েকজন হেঁটে যাচ্ছিল। জাবালে নূর বাসে ওঠার সময় অপর গাড়িটি বামে ঢুকে চাপা দেয় শিক্ষার্থীদের। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল করিম। আহত হয় সজীব, আরিসাসহ ১০-১২ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর। দুই সহপাঠীর মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। রোববার রাতেই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন মিমের বাবা জাহাঙ্গীর।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads