• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
মানসিক চাপে ছিলেন ইউএস-বাংলার পাইলট

নেপালে দুর্ঘটনার শিকার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

সংরক্ষিত ছবি

দুর্ঘটনা

তদন্ত প্রতিবেদনের বরাতে কাঠমান্ডু পোস্টের দাবি

মানসিক চাপে ছিলেন ইউএস-বাংলার পাইলট

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২৮ আগস্ট ২০১৮

নেপালে দুর্ঘটনার শিকার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজের পাইলট আবিদ সুলতান ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মারাত্মক মানসিক চাপ ও উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন বলে এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসার দাবি জানিয়েছে দেশটির ইংরেজি দৈনিক কাঠমান্ডু পোস্ট। গতকাল সোমবার এক প্রতিবেদনে পত্রিকাটি এ দাবি জানিয়ে বলেছে, পাইলট আবিদ ওই অবস্থায় একের পর এক যেসব ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ নেন, তার পথ ধরেই গত মার্চে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয় ফ্লাইট বিএস-২১১। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নেপাল   সরকার গঠিত তদন্ত কমিশনের ওই প্রতিবেদনের অনুলিপি হাতে পাওয়ার দাবি জানিয়ে কাঠমান্ডু পোস্ট লিখেছে, পাইলট আবিদ ত্রিভুবনে নামার প্রস্তুতির সময় বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ‘অসত্য’ তথ্য দিয়েছিলেন; এক ঘণ্টার ওই পুরো ফ্লাইটে তিনি ককপিটে বসেই ধূমপান করছিলেন।

এদিকে কাঠমান্ডু পোস্টের করা ওই প্রতিবেদনকে ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। নেপালের ওই তদন্ত দলে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে থাকা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট অপারেশন কনসালট্যান্ট সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহও কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনটি ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটা সম্পূর্ণ ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য। এমন কোনো কিছুই এখনো তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। তদন্ত প্রতিবেদন এখনো শেষ হয়নি। তারা কীভাবে জানলেন পাইলট ধূমপান করছিলেন- সে প্রশ্নও রেখেছেন তিনি। এম রহমতুল্লাহ বলেন, ‘রিপোর্টটি পাবলিশ করা হলে আমি আপনাদের (গণমাধ্যম) বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে জানাব।’

গত ১২ মার্চ ঢাকা থেকে ৬৭ যাত্রী ও চারজন ক্রু নিয়ে রওনা হয়ে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নামার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে ইউএস-বাংলার ফ্লাইট বিএস-২১১। এতে পাইলট আবিদ সুলতানসহ আরোহীদের ৫১ জনের মৃত্যু হয়। ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র আবিদ একসময় বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ছিলেন। বাহিনীতে তিনি ‘ব্রাইট অফিসার’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন বলে পরিচিতজনদের ভাষ্য। শতাধিকবার ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের অভিজ্ঞতাও ছিল আবিদের। তাই তার পরিচালনায় ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটি কীভাবে বিধ্বস্ত হলো- সে প্রশ্ন ওঠে তখনই। বিমানটি বিধ্বস্তের কারণ নিয়ে আসে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও। ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি জানায়, পাইলটের ভুলেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। আর ইউএস-বাংলার পক্ষ থেকে বলা হয়, নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হচ্ছিল তাদের।

মর্মান্তিক ওই ঘটনায় নেপাল সরকার গঠিত তদন্ত কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ না করলেও তার একটি কপি কাঠমান্ডু পোস্টের কাছে আছে বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ফ্লাইটের পুরো সময়ে প্রধান বৈমানিক আবিদের আচরণ তার স্বাভাবিক চরিত্রের সঙ্গে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না’। এ বিষয়টি আগেই নজরে আনা উচিত ছিল বলে নেপালি তদন্তকারীদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কাঠমান্ডু পোস্ট বলেছে, ইউএস-বাংলার জনসংযোগ বিভাগের জিএম কামরুল ইসলাম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অবতরণের সময়ের ছয় মিনিট আগে পাইলট আবিদ নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে তার উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ার নামানো ও লক করার কথা জানিয়ে বলেন, ‘গিয়ারস ডাউন, থ্রি গ্রিনস।’ কিন্তু ফ্লাইটের কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ যখন অবতরণের আগে শেষবারের মতো সব প্রস্তুতি মিলিয়ে দেখেন, তখন দেখা যায় ল্যান্ডিং গিয়ার নামানো হয়নি। এর কয়েক মিনিটের মাথায় ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ মডেলের উড়োজাহাজটি রানওয়ের একপাশে বিধ্বস্ত হয়ে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। তদন্ত প্রতিবেদনের বরাতে পত্রিকাটি দাবি করেছে, তদন্তকারীরা বলছেন, এক ঘণ্টার ওই ফ্লাইটে সুলতান ক্রমাগত ধূমপান করেছিলেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক এই পাইলটের সাড়ে পাঁচ হাজার ঘণ্টার উড্ডয়নের রেকর্ড ছিল। তবে তিনি তার ধূমপানের অভ্যাসের তথ্য বিমান সংস্থাকে জানাননি। এ থেকে তদন্তকারীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন ককপিটে থাকার সময়ে তিনি মানসিক চাপে ছিলেন।

তদন্তকারীরা বলেছেন, ককপিটের ভয়েস রেকর্ডারের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি ক্যাপ্টেন প্রচণ্ড মানসিক চাপ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ভয়েস রেকর্ডারে ককপিটে তার ও তার সহকারী পাইলটের মধ্যে এক ঘণ্টার কথোপকথন রেকর্ড হয়েছিল। কথোপকথন বিশ্লেষণ করে চিন্তিত আবিদ পরিস্থিতিগতভাবেও সচেতন ছিলেন না বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তদন্তকারীরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্লাইটের সময় আবিদ এয়ারলাইন্সের অপর এক নারী সহকর্মীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর বক্তব্য রেখেছেন। ওই নারী সহকর্মী ইন্সট্রাক্টর হিসেবে তার সুনাম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। অডিও রেকর্ডারের তথ্য অনুযায়ী, ফ্লাইটের এক পর্যায়ে পাইলট কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, তিনি ওই নারী সহকর্মীর আচরণে খুবই আঘাত পেয়েছেন ও হতাশ হয়েছেন। আর ওই নারীই একমাত্র কারণ যার জন্য তিনি কোম্পানি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। পাইলট আবিদ দুর্ঘটনার এক দিন আগে কোম্পানি থেকে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে তিনি কোনো লিখিত নথি জমা দেননি। সহকারী পাইলটের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে আরো তিন মাস কাজ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছার কথাও বলেছিলেন তিনি। পাইলট আবিদের মেডিক্যাল রিপোর্টের কথা তুলে ধরে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিজের ধূমপানের অভ্যাস নিয়ে অসত্য তথ্য দিয়েছেন তিনি। ২০১২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত নিজের দেওয়া ঘোষণায় তিনি বলেছেন, কখনই ধূমপান করেননি। ২০১৫ সালে তিনি লিখেছেন, ধূমপান করতেন কিন্তু ২০১০ সালে ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর সর্বশেষ ২০১৬  এবং ২০১৭ সালের মেডিক্যাল মূল্যায়নে তিনি লিখেছেন, কখনো ধূমপান করেননি তিনি।

২০১৫ সালে ইউএস বাংলায় যোগ দেন আবিদ সুলতান। বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালানোর আগে বাংলাদেশ বিমানের পাইলট ছিলেন তিনি।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, তার মানসিক চাপে থাকার ইতিহাস রয়েছে। মানসিক মূল্যায়নের পর ১৯৯৩ সালে তাকে বিমানবাহিনীর সক্রিয় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে ২০০২ সালে মানসিক পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়নের পর তাকে ফ্লাইট চালানোর উপযোগী ঘোষণা করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবিদকে নিয়োগের সময়ে তার মেডিক্যাল ইতিহাসও পর্যালোচনা করেনি ইউএস-বাংলা।

নেপালের এই প্রতিবেদনের বিষয়ে ইউএস-বাংলার মুখপাত্র ও ব্যবস্থাপক কামরুল ইসলামের কাছে কাঠমান্ডু পোস্ট যোগাযোগ করলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে কামরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ক্যাপ্টেনের কোনো প্রবলেম আমরা খুঁজে পাইনি। তার কোনো মানসিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল না। ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে’ ইউএস-বাংলার ভুল বের করতেই এমন প্রতিবেদন করা হচ্ছে বলেও মনে করছে সংস্থাটি। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনটি অসত্য দাবি করে ইউএস-বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, তদন্ত তো এখনো শেষ হয়নি, তদন্ত কমিটি এখনো আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি। তাহলে রিপোর্ট কোথা থেকে পেল কাঠমান্ডু পোস্ট। তিনি বলেন, ককপিটে ধূমপানের কথা বলা হয়েছে, তারা এটা কীভাবে জানাল? ককপিটে তো সিসি ক্যামেরা নেই। আবার বিমানের ভেতরে সামান্যতম ধোঁয়া হলে ফায়ার অ্যালার্ম বাজবে। ফলে ধূমপানের বিষয়টি কাল্পনিক। এ ছাড়া যে মানসিক চাপের কথা বলা হচ্ছে, এটিও সঠিক নয়। মূলকথা, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের আগে কোনো তথ্যই সঠিক বলা যাবে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads