• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
যেভাবে মৃত্যুকূপে রূপ নেয়

রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনের ভয়াবহতা

ছবি : সংগৃহীত

দুর্ঘটনা

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি

যেভাবে মৃত্যুকূপে রূপ নেয়

  • রেজাউল করিম হীরা
  • প্রকাশিত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে চকবাজারের পেছনেই চুড়িহাট্টা এলাকায় ছিল চতুর্মুখী যানজট। এক কদম আগ বাড়িয়ে পা ফেলারও জায়গা ছিল না। রিকশা-গাড়ি-ভ্যান আর মানুষে পুরো এলাকা গিজ গিজ করছিল। আশপাশের হোটেলসহ অন্য দোকানগুলোয়ও ক্রেতার আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। হঠাৎ করেই একটি পিকাপভ্যানের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরণের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে পাশের হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারে। সেখান থেকে বিস্ফোরিত হয় বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার। এরপর ওয়াহেদ ম্যানশনের বডি স্প্রের গুদামে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মুহূর্তেই সে আগুন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আর এতেই এত লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হন আরো অর্ধশত মানুষ।

সরেজমিন গতকাল শুক্রবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনাস্থলের ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় ছিল বডি স্প্রের গোডাউন। ভবনের নিচে অসংখ্য বডি স্প্রের কৌটা পড়ে থাকতে দেখা যায়। নিচে পড়ে থাকা অনেক কৌটার গায়েও লেখা দেখা যায় ইনফ্লেম্যাবল লিকুইড। এসব পাউডার উচ্চ দাহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। এমন দাহ্য পদার্থের কারণে আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েই মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুকূপে পরিণত হয় জায়গাটি।

ভবনটির বেজমেন্টে গিয়ে দেখা মেলে শত শত ড্রাম, বিভিন্ন কন্টেইনার ও প্যাকেটে নানা ধরনের কেমিক্যাল। রং তৈরিতে ব্যবহূত হতো এসব কেমিক্যাল, পাউডার এবং লিকুইড। কেমিক্যালে ভরপুর পুরো বেজমেন্ট। আগুন যদি বেজমেন্ট পর্যন্ত আসত তাহলে আগুনের ভয়াবহতা ও নির্মমতা কোন পর্যায়ে যেত তা কল্পনাতীত।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ওয়াহিদ ম্যানশনের বেজমেন্টে থাকা রাসায়নিকের গুদাম পর্যন্ত আগুন পৌঁছালে বিস্ফোরণের মাত্রা হতো ব্যাপক। এতে আগুন নেভাতে সময় লাগত অনেক বেশি। ফলে বেড়ে যেত হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যেও উঠে আসে আগুনের ভয়াবহতার কথা। তারা বলেন, প্রথমে গাড়ির গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। তারই উত্তাপে পাশের হোটেলটির গ্যাস সিলিন্ডার এবং বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারও বিস্ফোরিত হয়। এতেই মৃত্যুকূপে পরিণত হয় চুড়িহাট্টার ওই গলির মোড়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সে আগুনে ভবনের মানুষ ছাড়াও যানজটে আটকে থাকা মানুষও পুড়ে ছাই হয়েছেন। ওই ভবনটির নিচেই সেদিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল গাড়ি। আর সড়কে ছিল মানুষ আর যানবাহনের জটলা। ফলে আগুনে তখন ওই সড়কে থাকা রিকশা আরোহী, পথচারী এবং দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনও দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী নাসির উদ্দিন জানান, ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবনের পাশেই ছিলেন তিনি। ওই ভবনের নিচে একটা পিকআপ ভ্যান ছিল, সেটার গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পাশের হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারে আগুন লাগে। ওই হোটেলে ৩ থেকে ৪টি গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। সেখান থেকেই আগুনের ভয়াবহতা আরো বেড়ে যায়।

বিস্ফোরক পরিদফতরের ধারণা, ট্রান্সফরমার, গ্যাস সিলিন্ডার অথবা কেমিক্যাল বিস্ফোরণে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। গতকাল ঘটনাস্থল পরির্দশন শেষে বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল থেকে অনেক ক্লু পেয়েছি। ধারণা করা হচ্ছে, এ তিনটি কারণে আগুন লাগতে পারে। তিনি আরো বলেন, এই এলাকায় বেশ কিছু কেমিক্যালের দোকান রয়েছে। ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচে কিছু প্লাস্টিকের দানার দোকান ছিল। এ কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।’

তবে বিপুল পরিমাণ কেমিক্যালের কারণেই চকবাজারের আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল বলে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিদল। গতকাল শুক্রবার সকালে ১১ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দলও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন সমিতি। সেখানে কী ধরনের এবং কী পরিমাণ কেমিক্যাল ছিল তা খতিয়ে দেখেন তারা।

পরিদর্শন শেষে সিটি করপোরেশনের তদন্ত দল জানায়, এ এলাকায় কেমিক্যালের ব্যবসার কোনো অনুমোদন ছিল না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ‘এখানে ব্যবসা করার জন্য কোনো কেমিক্যালের লাইসেন্স দেওয়া হয়নি, এমনকি লাইসেন্স নবায়নও করা হয়নি। তারপরও যারা এখানে কেমিক্যালের ব্যবসা করছেন বা কেমিক্যাল রেখেছেন সেটা তাদের নিজস্ব বিষয় সিটি করপোরেশনের না।’

নিরাপত্তায় নিজেদেরও সচেতন হতে হবে উল্লেখ করে তদন্ত দলে থাকা রাজউকের কর্মকর্তা নুরুজ্জামান হোসেন বলেন, ‘রাজউক মাঝে মাঝেই পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নোটিশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সব সময় যে নোটিশ দিয়েই বলতে হবে এমন না। আপনি যে ভবনে বসবাস করছেন সেখানে কেমিক্যালের সামগ্রী মজুত রাখছেন এটাতো আপনারও সচেতনতার বিষয়।’

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার জানান, ‘কেমিক্যালের কারণেই আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। পুড়ে যাওয়া ভবনগুলো এখনো ঝুঁকিতে আছে। এ ভবনগুলো এখন আর ব্যবহার করার অবস্থায় নেই। কারণ অগ্নিকাণ্ডের ফলে ভবনের মূল কাঠামো এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যাতে যেকোনো সময় ভবনগুলো ধসে পড়তে পারে।’

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অগ্নি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, ‘এ ঘটনায় কেউ দায়ী কি-না তা খতিয়ে দেখা এবং অগ্নিকাণ্ডের উৎস খুঁজে বের করা। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড না ঘটে সেজন্য সুপারিশ প্রদান করা।’

উল্লেখ্য, গত বুধবার রাতের ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে সরকারি হিসাবে ৬৮ জন জীবন্ত দগ্ধ হয়ে নিহত হন। আহত হন আরো অর্ধশত মানুষ। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads