• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
মৌসুমি ফলের বাজারে আমের রাজত্ব

ফাইল ছবি

কৃষি অর্থনীতি

মৌসুমি ফলের বাজারে আমের রাজত্ব

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ৩০ জুন ২০১৯

কৃষি অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নাম আম। মধু মাসের মৌসুমি ফলের বাজারে রাজত্ব করছে আম। মধু মাসের ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম আম, জাম, লিচু ও কাঁঠাল। এদের মধ্যে উৎপাদন, বাজার মূল্য, জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে আম। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল হলেও আমের জনপ্রিয়তা বেশি। রাজকীয় ফল আম পুষ্টিগুণের পাশাপাশি লাভজনক অর্থকরী ফসল হিসেবেও জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। আম আমাদের জাতীয় ফল না হলেও আমের জনপ্রিয়তা ফলের মধ্যে শীর্ষে। পৃথিবীতে আম উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোতে আমের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমের চাষ বেড়েছে অনেক গুণ। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই আমের ফলন হলেও রাজশাহীর আমের আছে অনেক সুনাম। আমের রাজধানী-খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরো অর্থনীতিই আমকে ঘিরে। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে কেন্দ্র করে বছরে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। বছরে কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জেই বিক্রি হয় প্রায় ছয় কোটি টাকার দুই লাখ আমের চারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আট শ জাতের আম চাষের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১১টি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ২১টি আমের জাত উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে আম্রপালি সবচেয়ে জনপ্রিয়। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন  বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শরফ উদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, উৎপাদিত আমের ১০ শতাংশ আম স্বাস্থ্যসম্মতভাবে উৎপাদনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এটা পুরোটা করতে পারলে এক আম দিয়েই  দেশের অর্থনীতি পাল্টে দেওয়া যাবে।

বাংলাদেশের আমের সুনাম আছে বিশ্বে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে যখন আম পাকে, তখন বিশ্ববাজারে আর কোনো আম পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমের অবদান কোনো অংশে কম নয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে আম চাষ হয় প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে। আমের উৎপাদন উৎপাদন কমবেশি ১৪ লাখ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাব বলছে, বাংলাদেশে আম উৎপাদন হয়েছে সাড়ে ১২ লাখ টন।  উৎপাদিত আমের বাজারমূল্য প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিযোগ্য আমের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার টন। আশা জাগানিয়া খবরটি হলো-বাংলাদেশের ল্যাংড়া ও আম্রপলি আম যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আম রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনাটি হলো, বাংলাদেশের আম যখন পাকে তখন, বিশ্ববাজারে অন্য কোনো দেশের আম আসে না। যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু ফল হিসেবে বাংলাদেশের আমকে বেশ পছন্দ করছে। গুণে ও মানে অতুলনীয় হওয়ায় বিশ্ববাজারে দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশের আমের চাহিদা। রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট  কোম্পানি এই আম রপ্তানি করবে জার্মান, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন  দেশে। এ কারণে সরকার আম উৎপাদনে মাঠ পর্যায়ে তদারকি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে উৎপাদন করতে পারলে বছরে এক হাজার টন আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে। ফিলিপাইন ‘স্পার্জিং’ পদ্ধতিতে বছরের অধিকাংশ সময় আম উৎপাদন করে এবং নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে থাকে। ভারতও একইভাবে আমি রপ্তানি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। আম উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন,  দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আম হতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য।

বাংলাদেশের সব অঞ্চলে আমের চাষ হলেও উন্নত জাতের আম হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ ও দিনাজপুরে। আম উৎপাদনে দেশে দ্বিতীয় অবস্থানে সাতক্ষীরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থিত আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, দেশের ২২টি  জেলায় এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমের চাষ হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সব জেলায় আমের চাষ বাড়াতে বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনে গবেষণা হচ্ছে। এমনকি উপকূলীয় লবণাক্ত ভূমিতেও এখন মিষ্টি আমের চাষ শুরু হয়েছে। আনন্দের সংবাদ হলো, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আমের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে রপ্তানি তালিকায় নতুন যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্য আম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নতুন আশার পথ উন্মোচন করেছে। জানা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি আমগাছ রয়েছে। বাণিজ্যিক চাষে আগ্রহীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে আমগাছ ও বাগানের সংখ্যা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে প্রতি বছর নতুন করে আট হাজার হেক্টর জমি আম চাষের আওতায় আসছে। ফলে বছর প্রতি আম উৎপাদন বাড়ছে ৫০ হাজার টন। 

রংপুরে এখন হাঁড়িভাঙ্গা আম চাষে বিপ্লব চলছে। যা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হলে আমের রাজধানী রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রংপুরের গ্রামগঞ্জের কৃষকেরা হাঁড়িভাঙ্গা আম উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। রংপুর কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, রংপুর বিভাগের আট জেলায় হাঁড়িভাঙ্গা আমবাগানের পরিমাণ ৪৫ হাজার ৫০০ হেক্টর। বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তারা বলছেন, হাঁড়িভাঙ্গা আমের এ সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে অবিলম্বে এখানে আম গবেষণা কেন্দ্র, হিমাগার স্থাপন ও চাষিদের উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে বছরে সাত হাজার  কোটি টাকার আম উৎপাদন সম্ভব। আমের ক্ষেত্রে নতুন সুসংবাদটি হলো, চাঁপাইনবাবগঞ্জ রিজিওনাল হর্টিকালচার রিসার্চ স্টেশনের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বারি আম-১১ নতুন জাতের আম বছরে চারবার ফলন  দেবে। জানা যায়, প্রথমে মে মাসে, দ্বিতীয় পর্যায়ে আগস্ট মাসে, তৃতীয় পর্যায়ে নভেম্বর এবং চতুর্থ পর্যায়ে ফেব্রুয়ারি মাসে এই আম পাকবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মঞ্জুুর হোসেন এক থেকে দুই মাস আম সংরক্ষণের পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এই উদ্ভাবনকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে সরকার ভাবতে পারে। আমবাগান বৃদ্ধির পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত কর্মজীবীর সংখ্যাও বাড়ছে। আমের  মৌসুমে এখানে আট  থেকে ১০ লাখ লোক আমগাছ পরিচর্যা, বাগান পরিষ্কার রাখা, আম সংগ্রহ, বিক্রি ও পরিবহন ইত্যাদি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সেখানকার নারী থেকে শিশুরাও আমকেন্দ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। পুরো রাজশাহী অঞ্চলে আমকে কেন্দ্র করে আমবাগান, বাগান লিজদার, বাগান প্রহরী, বাগান পরিচর্যাকারী, বহনকারী, আড়তদার, অস্থায়ী  হোটেল ব্যবসায়ী, ঝরা আমের কারবারি-এসব নানা কর্মের চাঞ্চল্য লক্ষণীয়। আম কেটে শুকিয়ে তৈরি করা আমচুর কিংবা আমসত্ত্বের আছে কোটি টাকার বাজার।

ভারত, পাকিস্তান এমনকি সৌদি আরবও আমজাত পণ্যের অগ্রগতি ঘটিয়েছে। কৃষিপণ্য আমকে শিল্পপণ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে আমশিল্প গড়ে তোলার সব রকম  উপকরণই বাংলাদেশে রয়েছে। আম থেকে তৈরি হতে পারে আমের রস, আমের মোরব্বা, আমের স্কোয়াশ, আমের জেলি, আমের পাল্প, আমের টফি, আমের মধু, আমসত্ত্ব, আমের বরফি, আমের আচার, আমের জ্যাম, আমের পাউডার। আম ফলের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে জুসশিল্প। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমের জুস এখন রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দেশের অভ্যন্তরে ও রপ্তানি মিলে জুসের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার।

জুসের বাজারে প্রাণ, আকিজ, একমি, সজীব, ট্রান্সকম ও পারটেক্স গ্রুপ এগিয়ে আছে। জুসের বাজারে প্রাণ গ্রুপের ব্র্যান্ড ফ্রুটো, আকিজের ফ্রুটিকা, একমি গ্রুপের একমি, সজীব গ্রুপের সেজান, ট্রান্সকমের স্লাইস ও পারটেক্স গ্রুপের ড্যানিশ প্রভৃতি। বাংলাদেশের জুস রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ-আরব আমিরাত, আবুধাবি, দুবাই, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান ছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত  দেশ ইতালি, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের বাজারে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটি হচ্ছে, দেশে উৎপাদিত এবং বাজারজাতকৃত জুস ও ফ্রুট ড্রিংকসে মেশানো হচ্ছে  ভেজাল। আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ব্যাপক উৎপাদন ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার পরও দেশে সঠিক সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার ফলে আম আহরণের পর প্রায় ৩৩ শতাংশ আম নষ্ট হয়। এই পরিমাণ আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আয় হওয়ারই কথা। অনুসন্ধানে জানা যায়, আমচাষিদের সহায়তা দিচ্ছে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আম রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে হলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিজ্ঞানসম্মতভাবে অধিক উৎপাদনশীল আমগাছ লাগাতে হবে। উন্নত জাতের মিষ্টি ও সুস্বাদু আমের চাষ বাড়াতে হবে। গাছে ফুল ধরা থেকে শুরু করে ফল পারার আগ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

ফ্রুট ড্রিংকস ও জুসশিল্প বিকাশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আম চাষে কৃষকদের সতর্কতা এবং ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন আবহাওয়া উপযোগী আমের নতুন জাত উদ্ভাবন ও পাহাড়ি অঞ্চলে ফলটির আবাদ বাড়াতে হবে। আমকে প্রক্রিয়াজাত করে শিল্পপণ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে বড় ধরনের বাজার সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে হবে। আমচাষিদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads