• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
সম্ভাবনার সুন্দরবন

সংগৃহীত ছবি

কৃষি অর্থনীতি

প্রাকৃতিক অর্থনীতির খনি 

সম্ভাবনার সুন্দরবন

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২৪ জুলাই ২০১৯

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান অপরিসীম। প্রকৃতির স্বর্গ এবং বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন ক্ষতিকর কার্বন হজম করে বিশ্বের উষ্ণতা রোধে অবিচল অবদান রাখছে। লাখ লাখ মানুষের জীবিকার পাশাপাশি সরকারও প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। সহস্রাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কর্মস্থল এই সুন্দরবনে। সুন্দরবনের জ্বালানি, অভ্যন্তর ভাগ ও সমুদ্র এলাকায় বিপুল মৎস্যসম্পদ, বনজসম্পদ, মধু ও মোম এবং বন্যপ্রাণী সম্পদ- সব মিলিয়ে সুন্দরবনকে বাংলাদেশের অর্থনীতির মিনি খনি বললেও ভুল বলা হবে না। সুন্দরবনের মধু, মাছ, কাঁকড়া, প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণী বিশ্ববিখ্যাত  ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য।

সুন্দরবনের দৃশ্য নয়নাভিরাম এবং ২৪ ঘণ্টায় সুন্দরবন তার অপরূপ রূপ বদলায় ছয়বার। সুন্দরবনের ৭৩ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে সুন্দরী বৃক্ষ। সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্যের কারণেই বোধকরি এই অরণ্যের নাম সুন্দরবন। ধারণা করা হয়, কমপক্ষে ২৭০ প্রজাতির সরীসৃপ আছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের নদীনালায় এখন বিরল প্রজাতির মাছের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অতি পরিচিত ১২ রকমের ব্যাঙের অভয়াশ্রম এখনো এই সুন্দরবনে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে রক্ষাকবচ

সুন্দরবন শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিই নয়, এটি বৃহত্তর খুলনা জেলা তথা, দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকেও রক্ষা করে আসছে এবং এর মাধ্যমেই এ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে আসছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন আপন শক্তিতে কাল-কালানমশরের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছে। দুইশ বছরে ৩০ বার বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো সামুদ্রিক দুর্যোগ আঘাত হানে এ বনের ওপর। এর ফলে গাছপালা ধ্বংস হয় প্রচুর, বন্যপ্রাণীও মারা যায় বিশাল সংখ্যায়।

সর্বশেষ সিডর, আইলা, লায়লা, মহাসেনের ব্যাপক বিপর্যয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ অঞ্চল সুন্দরবন, যার ক্ষতি এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের পক্ষে। এই সুন্দরবন না থাকলে ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, আইলা, সিডর কোনো কিছু থেকেই বাংলাদেশের মহাবিপর্যয়কে ঠেকানো যেত না। অন্যভাবে যদি বলা যায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের নির্মম পরিণতির হাত থেকে সুন্দরবন যদি বাংলাদেশকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হতো, তাহলে প্রথমত উপকূলীয় এলাকার কোনো অস্তিত্ব থাকত বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। সেখানে কোনো জনবসতি, জনমানব এমনকি পশুপাখিও টিকে থাকতে পারত কিনা সন্দেহ আছে। প্রশ্ন হলো, তারপরও কি সুন্দরবনের সুরক্ষায় আর কোনো যুক্তি-তর্কের প্রয়োজন আছে? আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই এই অপার সম্ভাবনা, সম্পদ, সৌন্দর্যের প্রতীক সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে।

প্রাণবৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক ভান্ডার

সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। দেশে সংরক্ষিত বনের ৫১ শতাংশই সুন্দরবনের বনাঞ্চল। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট- এই তিন জেলায় সুন্দরবন অবস্থিত। প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা বাংলাদেশে এবং এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ভারতে অবস্থিত। মোট আয়তনের ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থিত। প্রাণ, প্রকৃতি ও জীবিকার পারস্পরিক নির্ভরশীলতায় প্রাকৃতিক  মেলবন্ধন ঘটিয়েছে এই সুন্দরবন।

সুন্দরবনের ওপর প্রায় ৬ লক্ষাধিক বনজীবী-বাওয়ালি  মৌয়ালি, জেলে, জোংরাখুটা (চুনারি), মুন্ড, মাহাতো এবং অন্যদের জীবন-জীবিকা সরাসরি নির্ভরশীল। এখানে আছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল এবং ১৩ প্রজাতির অর্কিড। চিতল হরিণ, বানর, শূকর, গুঁইসাপ, পাইথন ও বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ ৩৭৫-এর অধিক বন্যপ্রাণী, তিনশ’রও  বেশি প্রজাতির পাখি এবং জালের মতো বিছানো ৪৫০টির মতো নদী-খাল এবং কুমির, হাঙ্গরসহ প্রায় ২৯১ প্রজাতির মাছের শ্রেষ্ঠ বাসস্থান সুন্দরবন। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নদীগুলোর ভূমিকা অন্যতম। সুন্দরবনের বুক চিরে বয়ে চলেছে ৪০০ নদীনালা এবং ২০০ খাল। এসব নদী ও খালে রয়েছে প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ২০ প্রজাতির চিংড়ি, ৭ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬ প্রজাতির ঝিনুকসহ আরো অন্যান্য প্রজাতি।

প্রাকৃতিকভাবেই ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টির সম্ভাবনা

আশার খবরটি হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কর্মকাণ্ডের কারণে সুন্দরবনের কিছু এলাকা উজাড় হয়েছে। আবার ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের এ বনে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন ম্যানগ্রোভ বন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের কোনো কোনো এলাকায় প্রাকৃতিকভাবেই ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি হচ্ছে। নিজের মতো টিকে থাকার সুযোগ দিলে ওই বনভূমি দিন দিন বাড়তে থাকবে, ভূমিকা রাখবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায়। জোয়ারভাটায় লবণ ও মিঠা পানির ওঠানামার এক সমীকরণে ম্যানগ্রোভ যেমন জন্মে, তেমনি টিকেও থাকে। জোয়ারের সময় পানির উপরে মূল তুলে শ্বাস নেয় বলেই এর নাম শ্বাসমূলীয় বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। প্রাকৃতিক পরিবেশ স্বাভাবিক রাখা গেলে ম্যানগ্রোভ আপনা আপনিই বাড়বে, মত বিশেষজ্ঞদের। আর এ কারণেই বনকে অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিচ্ছে বন বিভাগ।

পর্যটন সম্ভাবনা

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন যেমন দেশি-বিদেশি পর্যটকের কাছে আকর্ষণীয় স্থান, তেমনি এর অর্থনৈতিক প্রভাবও ব্যাপক। ২০১৬-১৭ সালে সুন্দরবন বন বিভাগ পর্যটকদের কাছ থেকে মোট ৮২ লাখ ৬২ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করে যা ২০১৫-১৬ সালে ছিল ৭৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। মূলত বিদেশি পর্যটকদের থেকে বেশি রাজস্ব আহরণ করা হয়। তাই বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়লে রাজস্বের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু সুন্দরবনে দেশি পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আশানুরূপ নয়। এর প্রধান কারণ সঠিক প্রচারের অভাব। তাছাড়া সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটকদের জন্য নেই কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা। তাই সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনকে আরো বেগবান করতে হলে নিতে হবে নানা পদক্ষেপ। তবে সবকিছুর মূল কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। পরিবেশ ও সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের ক্ষতি করে কোনো উন্নয়ন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাছাড়া সুন্দরবনে প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অন্য প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে চোরা শিকারি ও বন উজাড় করাসহ নানাবিধ কারণ রয়েছে। তাই এসব সমস্যা চিহ্নিত করে অতিদ্রুত সমাধান করতে হবে।

ডেঞ্জার জোনে সুন্দরবন

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবন এমনিতেই ডেঞ্জার জোনে আছে। তাই গত এক দশকে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। এক গবেষণায় দেখা যায়, সুন্দরবনের যেখানে লবণাক্ততা কম সেখানে ৩০ প্রজাতির, যেখানে মাঝারি সেখানে ২১ প্রজাতির এবং যেখানে বেশি, সেখানে ১৩ প্রজাতির গাছ আছে। বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বার বার বলা হচ্ছে, বেশি মাত্রায় লবণাক্ত পানি সুন্দরবনে প্রবেশ করায় সুন্দরী, পশুর, গরান, বাইন, কাঁকড়া, গেওয়া প্রভৃতিসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ ও উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। বন বিভাগের তথ্যে জানা গেছে, ১০ বছরে সুন্দরবনের চাঁদপাই, শরণখোলা, সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় বাস্ট ও উপজয়িং রোগে ৭৫ লাখ গাছ মারা গেছে। হারিয়ে গেছে বেশ কয়েক প্রজাতির উদ্ভিদ। তাছাড়া লবণাক্ততা বাড়তে থাকায় সুন্দরবনের জীবজন্তু, পশু-পাখির আহার-বিহার ও প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে।

সুন্দরবন সুরক্ষায় সরকারের উদ্যোগ

আমরা জানি, ১৯৭২ সালে বিশ্বের তাবৎ প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্বঐতিহ্য প্রটোকল প্রণয়ন করে। ১৯৯৭ সালে ১৪০টি দেশ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের সদস্য তালিকায় বাংলাদেশও এই প্রটোকল সই  করে। তারপরও সুন্দরবন সুরক্ষার তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কিছুদিন আগে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে ইউনেস্কো, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেটিভ অব নেচার (আইইউসিএন) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এরই প্রেক্ষিতে বিশ্বঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) সুন্দরবনের সুরক্ষায় সরকার এবার প্রায় ৪৬০ কোটি টাকা ব্যয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই পদক্ষেপ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে আরো বেশি সুরক্ষিত করবে বলে দাবি করেছে বন বিভাগ।

সুন্দরবন সুরক্ষার নামে পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে বন রক্ষায় কৌশলগত পরিবর্তন নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উন্নয়ন-আধুনিকায়নসহ প্রতিবেশ পর্যটন (ইকো ট্যুরিজম), সার্বক্ষণিক বন পাহারায় অত্যাধুনিক জলযান সংগ্রহ, ঝুঁকির মধ্যে থাকা ২৮টি বন অফিস আধুনিকায়ন ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় আধুনিকায়ন থাকছে। বন বিভাগ বলছে, কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনজুড়ে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ‘স্মার্ট পেট্রোলিং’য়ের মাধ্যমে বন পাহারা দেওয়ায় এ বছর সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ১০৬টি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৪টিতে। খালে বিষ দেওয়া রোধে গত ১১ মার্চ থেকে সুন্দরবন অভ্যন্তরে ২৫ ফুট বা তার চেয়ে ছোট খালগুলোতে সারা বছর মাছ আহরণ নিষিদ্ধ ও ২৫ ফুটের বেশি প্রস্থ সব খালে মাছের প্রজনন মৌসুম জুলাই ও আগস্টে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করেছে বন বিভাগ।

লেখক : উন্নয়ন গবেষক

writetomukul36@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads