• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ধান সংগ্রহের সুফল পাচ্ছেন না প্রান্তিক কৃষক

ধান মড়াই করে পরিস্কার করার কাজ চলছে । ছবিটি জেলার বিরল উপজেলার মাঝাডাঙ্গা এলাকা থেকে তোলা

প্রতিনিধির

কৃষি অর্থনীতি

ধান সংগ্রহের সুফল পাচ্ছেন না প্রান্তিক কৃষক

  • দিনাজপুর প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

শস্যভান্ডার ও ধানের জেলা হিসেবে পরিচিত দিনাজপুর জেলার আমন ধান কাটা মাড়াই শুরু হলেও এবং আমন ধান সংগ্রহ অভিযান চললেও এখনও কৃষকদের তালিকা করে সরকারীভাবে ধান সংগ্রহ শুরু হয়নি। যাতে করে জেলার নিন্মবিত্ত ও নিম্নধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারগুলো প্রয়োজনের তাগিদে বাজারে নিয়ে গিয়ে ধান বিক্রি করছেন। এতে করে সরকারের উদ্দেশ্য তার সুফল পাচ্ছেন না প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা। যাতে করে লোকসানের মুখে তারা, পাশাপাশি কৃষকদের অভিযোগ রয়েছে, এর আগেও সরকারী মূল্যে ধান বিক্রি বা সরকারী গুদামে ধান দেয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত বেশিরভাগ এলাকার কৃষক। তাই কৃষকদের প্রকৃত তালিকা করে ধান সংগ্রহ করার দাবি কৃষক ও নেতাদের।

সরকারীভাবে আমন সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে ২০ নভেম্বর থেকে, যেটি চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে দিনাজপুর জেলায় ২৬ টাকা দরে কৃষকদের কাছ থেকে মোট ২৮ হাজার ৭ মেট্রিকটন ধান সংগ্রহ করা হবে। আর জেলায় মোট কৃষক রয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার জন। জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে সদরে ২ হাজার ৮৭৬, বিরলে ৩ হাজার ৫৩, বোচাগঞ্জে ১ হাজার ৮২৪, কাহারোলে ১ হাজার ৫৯৪, বীরগঞ্জে ৩ হাজার ২৩০, ফুলবাড়ীতে ১ হাজার ৮৭৮, খানসামায় ১ হাজার ৫১৬, পার্বতীপুরে ৩ হাজার ৬৭, চিরিরবন্দরে ২ হাজার ৫২০, বিরামপুরে ১ হাজার ৮৮৮, হাকিমপুরে ৮৯২, নবাবগঞ্জে ২ হাজার ৩৮৯ ও ঘোড়াঘাটে ১ হাজার ২৮০ মেট্রিক টন ধান কৃষকদের কাছ থেকে সরকারীভাবে সংগ্রহ করা হবে।

সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী ২০ নভেম্বর থেকে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করার কথা থাকলেও এই জেলায় এখনও সরকারীভাবে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের তালিকা করা হয়নি বেশিরভাগ এলাকাতেই। নিয়ম রয়েছে, কৃষকদের তালিকা প্রনয়ন শেষে লটারীর মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করার। কিন্তু তালিকা না হওয়ায় জেলার নিন্মবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারগুলো প্রয়োজনের তাগিদে বাজারে নিয়ে গিয়ে ধান বিক্রি করছেন। এতে করে সরকারের উদ্দেশ্য তার সুফল পাচ্ছেন না প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা। যাতে করে লোকসানের মুখে তারা। শুধু তাই নয়, কৃষকরা বলছেন- এর আগেও সরকারীভাবে ধান ক্রয় করা হলেও সরকারী মূল্যে ধান বিক্রির সুবিধা থেকে বঞ্চিত বেশিরভাগ এলাকার কৃষক।

ইতিমধ্যেই জেলার বিভিন্ন এলাকায় আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। অর্ধেকেরও বেশি জমিতে ধান কর্তণ সম্পন্ন হয়েছে। ফলন ভাল হওয়ায় এবারে খুশি কৃষকরা, বাজারেও দাম মোটামুটি ভাল। জেলার বিভিন্ন বাজারে বর্তমানে প্রকারভেদে ধান সাড়ে ১২শ’ থেকে ১৪শ’ টাকা বস্তা (৭৭ কেজি) দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে সার ও কীটনাশকের যে মূল্য তাতে করে এর থেকে বেশি বাজার হওয়া প্রয়োজন।

তবে ধান কাটা-মাড়াই ও বাজারে ক্রয়-বিক্রয় শুরু হলেও সরকারীভাবে কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ শুরু হয়নি। কৃষকরা বলছেন, এখনও তাদের তালিকায় করা হয়নি। কিন্তু ধান কাটা-মাড়াইয়ের খরচ যোগাতে এবং ধার-কর্য্য প্রদানসহ অন্য ফসল আবাদে অর্থের প্রয়োজন। তাই তাদেরকে বাজারে কম দামেই ধান বিক্রয় করতে হচ্ছে। গত বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে যে ধান সংগ্রহ করা হয়েছিল সেখানেও অনেকেরই তালিকা হয়নি, অনেকেই ধান দিতে পারেনি। কৃষকরা বলছেন, অন্ততপক্ষে দ্রুত প্রকৃত কৃষকদের তালিকা করা হোক। যাতে করে তারা সরকারী গুদামে ধান দিতে পারে।

বিরল উপজেলার মাঝাডাঙ্গা এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এক বস্তা ধান ১৩শ’ থেকে ১৪শ’ টাকা। কিন্তু ভ্যানভাড়া দিতে হচ্ছে বস্তাপ্রতি ৪০ টাকা, ২০ টাকা খাজনা দিতে হচ্ছে। আমাদের কোনভাবেই পোষাচ্ছে না। সরকারকে আমরা ধান দিতে পারছি না। সরকার যদি আমাদের তালিকা নিত, যত শুকনাই দিতে হোক আমরা দিতাম। কিন্তু আমাদের কাছে ধান নেয়া হচ্ছে না।’

একই এলাকার কৃষক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার যদি ধান নেয় তাহলে তো আমরা দিতে রাজি। সরকার কখন ধান নিবে তার কোন ঠিক নেই। ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়ে গেছে, এখন আমাদের টাকার প্রয়োজন। আমাদের তো ধান বাধাই করার উপায় নাই। ধার-দেনা শোধ করতে হবে এবং অন্য ফসল আবাদ করতে হবে। এখন টাকার প্রয়োজন, তাই বাজারে কম দামেই ধান বিক্রি করছি। সরকার ধান নেয় কখন, কি হিসাবে নেয়, তার কিছুই জানা নেই। এর আগেও কখনো ধান নেয়নি, তালিকাও হয়নি।’

কাহারোল উপজেলার দশমাইল এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার কোন তালিকা করেনি। এর আগেও কখনো আমার তালিকা করা হয়নি। যার কারনে সঠিক দাম পাচ্ছি না। যদি আমরা সঠিক দাম না পাই তাহলে গৃহস্থালি করে কি লাভ, এর চেয়ে অন্যের জমিতে কামলা খাটাও ভাল। যদি সরকারের গুদামে ধান দিতে পারি তাহলে কিছুটা লাভবান হবো। তাই আমার মত কৃষকের যাতে তালিকা হয় এই দাবি করছি।’

সদর উপজেলার শেখপুরা এলাকার কৃষক নুর ইসলাম বলেন, ‘সরকার যদি ধান নেয় তাহলে আমরা লাভবান হবো এবং ধান রোপন করতে উৎসাহিত হবো। এর আগে কখনোই সরকারী গুদামে ধান দিতে পারিনি, এবারে যেন ধান দিতে পারি। সরকার ধান নিচ্ছে ২০৮০ টাকা বস্তা সেখানে আমাদেরকে বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে সাড়ে ১২ থেকে ১৪শ’ টাকা বস্তা। দ্রুত প্রকৃত কৃষকদের তালিকা করা হোক যাতে করে আমরা ধান দিতে পারি।’

বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, আমরা শুনছি এখনও অনেক কৃষকের তালিকা করা হয়নি। গত মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের লটারীর নামে প্রহসন করা হয়েছে। এবারে যাতে প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা হয় এজন্য প্রকৃতত সকল কৃষকের তালিকা করে অবাধ ও নিরপেক্ষ লটরী করে তাদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে হবে। তারা যেন লাভজনক দামে ধান বিক্রয় করতে পারে, তাহলে তাদের উৎপাদন খরচ উঠে আসবে। দেশে এবারে কমপক্ষে ১০ লাখ টন ধান সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা উচিত বলেও জানান তিনি।

দিনাজপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আশ্রাফুজ্জামান জানান, কৃষকদের তালিকা দেয়া হয় কৃষি অফিস থেকে। সেখান থেকে তালিকা নিয়ে লটারী করার নির্দেশনা রয়েছে। কৃষি অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত এক লাখ ১৯ হাজার জন কৃষকের তালিকা আপলোড করেছে। কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ তালিকা আমরা পাইনি। এই তালিকা আরও বাড়তে পারে। প্রাপ্ত তালিকা অনুযায়ী জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে শুধুমাত্র বীরগঞ্জ উপজেলার কৃষকদের লটারী হয়েছে। তবে সেখানেও ধান সংগ্রহ শুরু হয়নি। আর ৪টি উপজেলার লটারীর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তালিকাভুক্ত কৃষকদের লটারী সম্পন্ন হলেই আমরা ধান সংগ্রহ শুরু করতে পারবো। যার ফলে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও জবাবদিহীতার সাথে ধান সংগ্রহ অভিযান সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ তার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads