• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
মধুপুর গড়ের কলাগাছের খোসা ও আনারসের পাতার তৈরি তৈজসপত্র যাচ্ছে বিদেশেও

ছবি: বাংলাদেশের খবর

কৃষি অর্থনীতি

মধুপুর গড়ের কলাগাছের খোসা ও আনারসের পাতার তৈরি তৈজসপত্র যাচ্ছে বিদেশেও

  • ধনবাড়ী (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৮ মে ২০২০

আনারস-কলার রাজধানীখ্যাত টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়াঞ্চালের কলা গাছের খোসা ও আনারসের পাতা থেকে তৈরি হচ্ছে ভালোমানের তৈজসপত্র। এসব তৈজসপত্র দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে বিদেশেও।

জানা যায়, গড়াঞ্চালের কলাগাছের খোসা ও আনারসের পাতা সংগ্রহ করে প্রথমে সোনালী আঁশ (জুট) তৈরি করা হয়। এসব সোনালী আঁশ বা জুট নীলফামারী ও ঢাকার শিল্প কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হচ্ছে উন্নতমানের কার্পেট, পা-পোস, রশি, ফুলদানিসহ নানাধরণের শৌখিন ও মূল্যবান তৈজসপত্র। কলা গাছের খোসা ও আনারসের পাতার ফাইভারে তৈরিকৃত শৌখিন জিনিসপত্র দেশ ছাড়িয়ে রপ্তানি করা হচ্ছে বিদেশেও। কলা গাছ ও আনারসের পাতার প্রচুর আধিক্য থাকায় মধুপুর গড় এলাকায় এ শিল্পের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

আর এ কাজটি ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু করেছেন মধুপুর উপজেলার শোলাকুড়ি ইউনিয়নের কাকড়াগুনি গ্রামের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা মজিবর রহমানের ছেলে আনোয়ার হোসেন (৪৮)।

সরজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেনের সাথে কথা বলে জানা যায়, মধুপুর গড় এলাকা কলা ও আনারস চাষের জন্য বিখ্যাত। এ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে কলা ও আনারস জন্মায়। যে কারণে মধুপুর গড় এলাকাকে আনারস- কলার রাজধানী বলা হয়ে থাকে। তিনি প্রথমে মোকাদ্দেছ নামের ঢাকার তার এক পরিচিত লোকের পরামর্শে ২০১৬ সালে শুরু করেন কলা গাছের খোসা ও আনারসের পাতা থেকে গোল্ডেন ফাইভার সোনালী আঁশ উৎপাদনের কাজ। তার মাধ্যমে ঢাকা থেকে ৩টি মেশিন ৬ লাখ টাকায় কিনে নিয়ে আসেন। মেশিন বসান তার বাড়ির আঙ্গিনায়। শুরু করেন কাজ। এ শিল্পের কাঁচামালের জন্য তাকে চিন্তা করতে হয় না। তার নিজ গ্রামেই প্রচুর পরিমাণে এ শিল্পের কাঁচামাল কলা গাছের খোসা ও আনারসের পাতা পাওয়া যায়। স্থানীয় নারী ও পুরুষ শ্রমিক দিয়ে কলা ও আনারসের বাগান থেকে সংগ্রহ করেন কাঁচামাল। প্রথমে মেশিন চালানোর জন্য চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে শ্রমিক আনেন। ধীরে ধীরে আনোয়ার ও স্থানীয় শ্রমিকরা শিখেন মেশিন চালানো। পরে আরও ২টি মেশিন এনে বসান। এভাবে বর্তমানে ৫টি মেশিন ও ৪০ জন দক্ষ নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন তার কারখানায়। এভাবে ৪ বছর যাবত তার কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে গোল্ডেন ফাইভার (সোনালী আঁশ)। প্রতিমাসে শ্রমিক, পরিবহন যোগাযোগ সব খরচ মিলিয়ে যা ব্যয় তা মিটিয়ে কিছু লাভ পান। ওই লাভ দিয়ে চালাচ্ছেন সংসার বাড়াচ্ছেন কারখানার পরিধি।

তার বাড়ির আঙ্গিনায় গড়ে তোলা কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, কাকড়াগুনি বাজারের পাশে বাড়ীর আঙ্গিনায় ২০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন এ ফাইভার কারখানা। এসব মেশিন এক সাথে বসানো হয়েছে। কারখানায় শ্রমিকরা কলা গাছের খোসা ও আনারসের পাতা দিয়ে ফাইভার তৈরি করছেন। পাশেই মেশিনের ভেজা ফাইভার ধোয়ার জন্য পলিথিন বিছিয়ে হাউজ করা হয়েছে। এখানে ফাইভার ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। পরিস্কার করা আঁশ বা ফাইভারগুলো রৌদ্রে শুকানো হয়। মেশিন ঘরের পাশেই টিনের ছাপড়া দিয়ে গুদাম ঘর তৈরি করেছেন। গুদামে উৎপাদিত মাল রাখা হয়। এ কারখানায় প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে কাজ চলে। কাকড়াগুনি গ্রামটি মূলত আদিবাসী গারো অধ্যুষিত একটি গ্রাম। কিছু মুসলিমের বসবাসও রয়েছে। পাশে মধুপুরের ঐতিহ্যবাহী শালবন। এ বনের উত্তর পাশ ঘেষা এ গ্রামটি।

স্থানীয়রা জানালেন, এ গ্রামের মাটি অত্যন্ত উর্বর। এ মাটিতে আনারস, কলা, পেপে, আদা, হলুদ, আমসহ নানা কৃষি ফসল উৎপাদন হয়। কলা ও আনারস চাষের সূত্র ধরেই এ কারখানা স্থাপন করেন আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার পড়াশুনা করে প্রাইমারী সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ৫ম শ্রেণির আগেই তার পাঠ চুকিয়ে যায়। পাড়াশোনা করতে না পারলেও মেধা ও বুদ্ধিতে তিনি পারদর্শী। মেধা ও মনন দিয়ে কিভাবে আত্মকর্মসংস্থান ও এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান করা যায় এ বিষয়ে তিনি ভাল বুঝেন। পরিবার গঠনের ক্ষেত্রেও তিনি তার স্বাক্ষর রেখেছেন। সংসারে ২ ছেলে ১ মেয়ে। তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা এ কাজে তাকে সহযোগিতা করে।

আনোয়ার আরও জানান, পাহাড়ী এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত ও মধুপুর শহর থেকে দূরত্ব বেশি থাকার কারণে পরিবহন খরচ বেশি হয়। এজন্য তিনি উৎপাদিত পণ্য বস্তায় প্যাকেট করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মোকামে পাঠান। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে তার খরচ হয় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। খরচ বাদে প্রতিমাসে তার কিছু লাভ থাকে। তা দিয়ে তার সংসার চলে। অর্থের অভাবে তিনি কারখানার পরিধি বাড়াতে পারছেন না। অর্থের সংস্থান পেলে তিনি কারখানার পরিধি বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি ও আরো শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এজন্য তিনি সরকার ও বেসরকারী বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বড় আকারের কারখানা করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তিনি জানান, বিনা পয়সায় কাঁচামাল পাওয়া গেলেও তার এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটরের মাধ্যমে মেশিন চালাতে হয়। এতে খরচ বেশি পড়ে। যদি বিদ্যুতের ব্যবস্থা হতো তাহলে খরচ আরও কমে আসতো। প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকার জ্বালানি কিনতে হয়। অর্থের অভাবে কারখানার প্রাচীর ও ভালোভাবে গুদাম ঘর করতে পারছেন না। তার কারখানা ভালভাবে চালনের জন্য মালামাল পরিবহনের একটি গাড়ী, মেশিন বৃদ্ধিসহ কারখানার পরিধি বৃদ্ধির জন্য ১৫/২০ লাখ টাকা সরকারী ও বেসরকারী পর্যায় থেকে ঋণ পেলে এ কাজ করতে সহজ হবে বলে তিনি জানান।

এ ব্যাপারে স্থানীয় শোলাকুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আকতার হোসেন জানান, শোলাকুড়ি ইউনিয়নটি আনারস ও কলার জন্য বিখ্যাত। আনোয়ার হোসেন যে কাজটি শুরু করেছেন এটি একটি ভাল উদ্যোগ। এ শিল্পে কাঁচামালের অভাব নেই। সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আনোয়ার হোসেন একটি সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি পাবে এবং এর ফলে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। এ এলাকায় এ শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে এই এলাকা আরও এগিয়ে যাবে।

মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফা জহুরা জানান, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads