• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
সেন্টমার্টিনকে মিয়ানমারের ভূখণ্ড দাবি

সেন্টমার্টিনকে মিয়ানমারের ভূখণ্ড দাবি

ছবি : সংগৃহীত

বিশ্লেষণ

সংবাদ বিশ্লেষণ

সেন্টমার্টিনকে মিয়ানমারের ভূখণ্ড দাবি

এবারো ভুল স্বীকার নাকি ভিন্ন উদ্দেশ্য

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মিয়ানমার সেন্টমার্টিনকে আবারো নিজেদের ভূখণ্ড দাবি করল। এই ঘটনা দুদেশের সুসম্পর্ককে জটিল করার ইঙ্গিতই দেয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মিয়ানমার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি করতে চায়। যার প্রথম পর্বটি আরাকান রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে দেশান্তরি হতে বাধ্য করে। বাংলাদেশ মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবাসনে বিশ্ব নেতাদের সহযোগিতা চেয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ একমত এবং এ বিষয়ে মিয়ানমারকে অনেকটা বাধ্য করার প্রক্রিয়ায় এনেছে। বাংলাদেশের এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহনশীল আচরণের প্রতি বিশ্ব নেতাদের সমর্থন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠায় কোণঠাসা হয়ে পড়ছে মিয়ানমার। নিজেদের অপরাধবোধ এবং শাস্তির অনুশোচনা থেকেই দম্ভোক্তি প্রকাশ করতেও দেখা যায় তাদের।

রোহিঙ্গা ইস্যুটি যখন বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয় সেইসঙ্গে বাংলাদেশের সহানুভূতির প্রতিও বিশ্ববাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন জোরালো হয়ে ওঠে। এর মধ্যেই নিজেদের হীনমন্যতা প্রকাশ করতে তারা বাংলাদেশের দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে নিজেদের দাবি করে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু করছে।

কেউ কেউ মনে করছেন, রাখাইনের বিশাল তেল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের বন্ধু দুটি শক্তিশালী দেশের প্রশ্রয়েই মিয়ানমার এমন হম্বিতম্বি করছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বার্থ ছাড়া কোনো দেশ সংঘাতের পথে যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সহনশীলতা দুর্বলতা নয়। মিয়ামনার যদি এই ধারণা থেকে কিছু করে তাহলে বড় ভুল করবে। কারণ বাংলাদেশ দুর্বল রাষ্ট্র নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ শক্তিতেও কম এগিয়ে নেই। এরপরও বাংলাদেশের উচিত হবে কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালতেই বিষয়টি নিষ্পত্তির চেষ্টা করা। যেভাবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার সমস্যা সমাধান সম্ভব হয়েছে।

আমরা জানি, সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ এক প্রাকৃতিক সম্পদের স্বর্গভূমি।  দ্বীপটির অবস্থান কক্সবাজারের  টেকনাফ  থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমারের উপকূল থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায়। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার মিয়ানমার সরকার তাদের জনসংখ্যা বিষয়ক মানচিত্রে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে নিজেদের অংশ হিসেবে দেখিয়েছে।

জানা গেছে, ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আগেরবার মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ভুল স্বীকার করা হয়েছিল। এবারো মিয়ানমারের ঢাকা মিশনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স অং খোয়া বিষয়টি নিয়ে ভুল স্বীকার করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন বিষয়টি কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে কূটনৈতিক চিঠি দিয়েছেন।

এদিকে, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ১৮৯০ সালে কিছু মৎস্যজীবী এ দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। এদের মধ্যে কিছু বাঙালি এবং কিছু রাখাইন সম্প্রদায়ের লোক ছিল। পরে ধীরে-ধীরে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হয়ে ওঠে সেন্টমার্টিন। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশরা এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়, তখন সেন্টমার্টিনকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখিয়ে মানচিত্র করা হয়। সে হিসেবে যুক্তিসঙ্গত ভৌগোলিক রূপরেখা অনুযায়ী ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিলে এই দ্বীপটিও বাংলাদেশের অংশ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

যদি তা-ই না হবে তাহলে ১৯৭৪ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপপুঞ্জকে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা চুক্তি হয় কীভাবে। সর্বশেষ ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতেও এর মীমাংসা করা হয়েছে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে দেখিয়ে। এত কিছুর পরও মিয়ানমার কেন বার বার এ ভুল করছে! এ ভুলের পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে কি না সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। 

সেন্টমার্টিন নিয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের দুই শিক্ষক- অধ্যাপক শেখ বখতিয়ার উদ্দিন এবং অধ্যাপক মোস্তফা কামাল পাশা। পাশা বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। এ প্রসঙ্গে আগেরবার মিয়ানমারের দাবির প্রেক্ষিতে এক বিবৃতিতে অধ্যাপক বখতিয়ার বলেন, প্রায় ৫০০০ বছর আগে টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল জায়গাটি। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের নিচে চলে যায়। এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণপাড়া জেগে ওঠে। এর ১০০ বছর পর উত্তরপাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে ওঠে।

গবেষক  মোস্তফা কামাল পাশাও তখন এক বিবৃতিতে বলেন, ২৫০ বছর আগে আরব বণিকদের নজরে আসে এ দ্বীপটি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের সময় আরব বণিকরা এ দ্বীপটিতে বিশ্রাম নিত। তখন তারা এ দ্বীপের নামকরণ করেছিল ‘জাজিরা’। পরবর্তীতে যেটি নারিকেল জিঞ্জিরা নামে পরিচিত হয়। তিনি বলেন, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সালের ভূমি জরিপের সময় এ দ্বীপটিকে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখন বার্মা ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল। তারপরও সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত না করে ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। অধ্যাপক বখতিয়ার উদ্দিন আরো বলেন, দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ হয়।

প্রশ্ন হলো এত কিছুর পরও জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বিশ্বে নিন্দিত হওয়ার এই কঠিন সময়ে মিয়ানমার কেন সেন্টমার্টিনকে তাদের অংশ দাবি করছে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব মিয়ানমার বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশকে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ছাড়াও তাদের অন্য কোনো গোপন ষড়যন্ত্র আছে কি-না?

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads