• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
সক্ষমতা একটি বড় অর্জন

প্রতীকী ছবি

বিশ্লেষণ

দুর্যোগ মোকাবেলা

সক্ষমতা একটি বড় অর্জন

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০১৯

ঝড়ের সঙ্গে, বানের সঙ্গে লড়াই করে বাঙালি বাঁচে।  আবহমান কাল ধরে এই বাঙালি দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবেলা করে চালিয়ে যাচ্ছে তার অস্তিত্বের সংগ্রাম। যাবতীয় বিরূপতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সীমাহীন সংগ্রাম-সাধনার মধ্য দিয়ে জাতি আজ এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে পরাজয়ের কোনো গ্লানি নেই। এখন সে খুব সহজেই উতরে যেতে পারে যে কোনো ভয়াল বিপর্যয়। ঘূর্ণিঝড় ফণী লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে উড়িষ্যার শহর-গ্রাম, নদী ও সমুদ্র উপকূল। পশ্চিমবঙ্গেও তাণ্ডব চালিয়েছে ফণী। বাংলাদেশে আমরা শংকিত ছিলাম, কখন হানা দেয় এই সর্বসংহারী। উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা অতিবাহিত করেছি কয়েকটি দিন ও রাত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় সফরে লন্ডনে অবস্থান করলেও নিরুদ্বিগ্ন ছিলেন না এক মুহূর্তের জন্যেও। দূর প্রবাসে কর্মব্যস্ততার মধ্যেও সার্বক্ষণিক মনিটর করেছেন পরিস্থিতি। আল্লাহর অশেষ রহমতে শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের কোথাও ফণী ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করেনি। ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেলেও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি দেশের কোনো প্রান্ত থেকেই। এ জন্যে শোকরিয়া।

তারপরেও কথা রয়েছে, যা আমাদের বোধ ও বিবেচনাকে আন্দোলিত না করে পারে না। ঘূর্ণিঝড় ফণী ধেয়ে আসছে— এই সংবাদ জানতে পারামাত্র বাংলাদেশ  তা মোকাবেলার জন্যে যে সর্বাত্মক এবং বাস্তবভিত্তিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তা গোটা জাতিকে শোনাতে পেরেছিল অভয়ের বাণী। দেশের অতি সাধারণ মানুষটিও বুঝে গিয়েছিল যে, ফণী যত তীব্র-কঠিন আঘাতই হানুক না কেন, বিপন্নতার চাদরে বাঙালি মুখ লুকাবে না আর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের পতাকাবাহী গণতান্ত্রিক সরকার সব শক্তি নিয়ে মানুষের পাশে রয়েছে। এবং কার্যকরভাবে দেশের মানুষকে সব বিপদ ও বিপর্যয় থেকে নিরাপত্তা দেয়ার শক্তি ও সামর্থ্যও সরকার অর্জন করেছে। সম্ভাব্য বিপর্যয় মোকাবেলায় কত ব্যাপক ও সুশৃঙ্খল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল তা সবাই জানেন, দেখেছেন, শুনেছেন। কাজেই এখানে তার পুনরাবৃত্তির খুব একটা প্রয়োজন নেই। তবু গৌরবের ইতিহাস সংক্ষণের স্বার্থে কিছু তথ্য বিবৃত করা বাঞ্ছনীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয়। সতর্ক ও প্রস্তুত ছিলেন আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছিল। উপকূলীয় জনপদের ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে তুলে আনা হয়েছিল আশ্রয় শিবিরগুলোতে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী প্রস্তুত ছিল। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক রাত দিন কাজ করে সর্বশেষ মানুষটিকেও নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসার জন্যে অবিশ্রান্ত তৎপরতা চালিয়েছেন।

কাজেই একথা আমরা বলতেই পারি যে, ফণী যদি তার ভয়াল রূপ নিয়ে আঘাত হেনে যেতো-ও, তাহলেও প্রাণহানির ঘটনা খুব বেশি ঘটত না।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় কতটা মৃত্যু-ভয়াল হতে পারে, বাঙালির চাইতে আর কে তা ভালো জানে। এই তো সেদিনের কথা, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রামের উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়-ভয়াল ঘূর্ণিঝড়। বিশ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস এবং ঘূর্ণিঝড়ে তখন প্রাণহানি ঘটে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের। বিরান প্রান্তরে পরিণত হয়েছিল উপকূলীয় জনপদ। স্বজনহারা মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল বাংলার বাতাস। শোকের লোবানের ঘ্রাণ আর সাদা কাফনের কাফেলায় মুহ্যমান হয়ে গিয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে, দুর্যোগ মোকাবেলায় আগে থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা হলে মানবিক বিপর্যয় তখনো বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভবপর হতো। পাকিস্তান আমলে সত্তর সালের ১২ নভেম্বরের ভয়াল গোর্কির ছোবলের কথা মনে হলে আজো গা শিউরে ওঠে, মর্মের বত্রিশ বাঁধন ছিঁড়ে যেতে চায়। সেই ঝড় জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারান লাখো নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। সেই দুর্যোগে উপকূলের কত পরিবার যে ছিন্নমূল হয়ে পড়েছিল, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ইসলামাবাদের সামরিক সরকার বাঙালির সেই মহাবিপদের দিনে ফিরেও তাকায়নি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহকর্মীরা সেদিন উল্কার বেগে ছুটে গিয়েছিলেন বিপন্ন মানুষের পাশে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপন্ন মানবতার ত্রাণকাজে। সেদিন বাঙালি আরো নিবিড়ভাবে বুঝতে পেরেছিল যে পাকিস্তান কখনোই তাদের দেশ হতে পারে না। সাহস-সংগ্রাম ও মানবপ্রেমের এক অপরাজেয় মহান পিতাকে তারা দেখতে পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে  যুদ্ধবিধস্ত দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর সরকার যখন শ্রান্তিহীন,  তখনই এলো উপর্যুপরি বানভাসির বিপর্যয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রবঞ্চনা ও অসহযোগিতা সত্ত্বেও সেই বিপর্যয় মোকাবেলা করেছে বাঙালি। আমরা দেখেছি ১৯৮৮ সালের ভয়াল বন্যা। সেই বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল বলতে গেলে সারা বাংলাদেশ। সেই বানভাসিতে হাজার হাজার পরিবার হয়েছে উন্মূল ুঅনিকেত। ১৯৯৭ সালে টানা একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন সরকার ক্ষমতায়, তখন আবার দেখা দেয় বন্যার তাণ্ডব। সেবার আওয়ামী লীগ সরকার যে আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পেরেছিল, তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে আইলা ও সিডরের বিপর্যয় দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করার। আইলার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছিল ভোলাসহ দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলে বহুসহস্র ঘরবাড়ি। সরকার দ্রুত বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ক্ষতিগ্রস্তদের কম সময়ের মধ্যেই পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়। সিডরের ক্ষতিও মোকাবেলা করা সহজ-সম্ভব হয়েছে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে।

এভাবে দুর্যোগ মোকাবেলার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি আমাদের সক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের আবহাওয়া বার্তা সংগ্রহের পদ্ধতি এখন আর নেই। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির কল্যাণে নিমিষের মধ্যেই আমাদের আবহাওয়া বিভাগ আকাশে-সমুদ্রে, কোথায় কী ঘটছে, তা জেনে যাচ্ছে এবং যথাসময়ে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে সরকার ও জনগণকে। অন্যদিকে অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তির সঙ্গে যোগ ঘটেছে দেশপ্রেমিক সরকারের সদিচ্ছা এবং সঠিক কর্মপরিকল্পনা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ আজ যে সক্ষমতা অর্জন করেছে, তা ইতোমধ্যে বিশ্বসমাজেরও মুগ্ধদৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারো নেই। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপদ বিপর্যয় মোকাবেলার শক্তি-সামর্থ্য ও আত্মবিশ্বাস আমাদের আছে। যেমন করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা ইতোমধ্যে অগ্রসরতার মাইলফলক স্থাপন করে চলেছি একের পর এক, যেমন করে প্রযুক্তির উন্নতি করে জীবনমানের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা হচ্ছে, যেমন করে আমরা পেরেছি মানবতার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে, তেমনি বাঙালি অর্জন করেছে যাবতীয় প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার শক্তি।

আর এই সাফল্যের পশ্চাতে রয়েছে বাঙালির প্রাণের শক্তি— বঙ্গবন্ধুর অক্ষয় আদর্শে অবিনাশী প্রেরণা এবং মুক্তিযুদ্ধের শাণিত চেতনা। সেই চেতনা আজ আরো অনেক বেশি বেগবান ও লক্ষ্যাভিমুখী হয়ে উঠেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। সরকারের সদাজাগ্রত কর্মতৎপরতা, সক্ষমতা জাতীয় জীবনে সঞ্চারিত করে যাচ্ছে নব-নতুন জয়ের স্পন্দন। ফণীর অবশেষের আঘাতে দেশের যেসব এলাকায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কমবেশি, তাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। এই ক্ষতের চিহ্ন আশা করি মুছে যাবে শিগগিরই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads