• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার

বাংলাদেশের খবরের নিয়মিত আয়োজন ‘আপন ভুবন’-এ গতকালের অতিথির (বাঁয়ে) সঙ্গে সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া

ছবি : বাংলাদেশের খবর

বিশ্লেষণ

বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সরকার বেসরকারি খাতের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এজন্য সব ধরনের নীতি সহায়তা যেমন দেওয়া হচ্ছে, একই সঙ্গে দেশীয় শিল্প যাতে সুরক্ষা পায় তার কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে ব্যবসায়ীদের কর দিতে আরো এগিয়ে আসতে হবে। অনেক ব্যবসায়ী দেশে ব্যবসা করে বিদেশে অর্থ সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। পরিবার ও ছেলেমেয়েদের বাইরে প্রতিষ্ঠিত করছেন। এটি দুঃখজনক। আমাদের সবাইকে সততা ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হতে হবে।

বাংলাদেশের খবরের সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। গতকাল তিনি অতিথি হয়ে আসেন বাংলাদেশের খবরের প্রধান কার্যালয়ে ‘সুবর্ণরেখায় বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানের ‘আপন ভুবন’-এ। কথা বলেন সমসাময়িক নানা ইস্যুতে। অনুষ্ঠানের শুরুতে আমন্ত্রিত অতিথিকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের খবরের সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া ও উপদেষ্টা সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আমার চাকরি জীবন ৩৮ বছরে। যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছি, চেষ্টা করেছি সততা, দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করতে। আমি সব সময় আমার সহকর্মীদের সততা ও দেশপ্রেমের দীক্ষা দিতে চেষ্টা করেছি। অনেকে হয়তো ভালোভাবে নিয়ে ভালোভাবে দেশের সেবা করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশে মিডিয়া যে ভূমিকায় থাকা দরকার সেটিতে অনেক সময় বিচ্যুতি

লক্ষ করা গেছে। সংখ্যায় বেশি থাকায় এমনটি হতে পারে। এছাড়া সব ক্ষেত্রে একই মন্ত্রে দীক্ষিত মানুষ না থাকায় বিচ্যুতি লক্ষ করা গেছে। দেশ ও সমাজ থেকে গণমাধ্যম আলাদা হতে পারে না। দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের দেশে ৫-৭ জন মানুষ একসঙ্গে বসলে একমত হতে পারেন না। প্রত্যেকে তার নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আলোচনার মধ্য দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেন না।

তিনি আরো বলেন, আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ২৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় আয়ের আরো অনেক উপাদান হিসাবে আসে না। আমাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অবদান হিসাবে আসছে না। এটি হিসাবে এলে জিডিপির আকার আরো বেশি হবে। এই উচ্চ জিডিপির কারণ হলো, স্বাধীনতার পর প্রত্যেকের চিন্তা এসেছে, দেশটা আমাদের। এখানে যা কিছু হবে সব আমাদের থাকবে। আর ভালো থাকার ইচ্ছা সবারই। তাই মানুষ স্ব-উদ্যোগে কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

আলাপকালে সাবেক এই শিল্প সচিব বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের দেশেও অনেক শিল্প হয়। তবে কিছুটা অব্যবস্থাপনা ও মানুষের লোভের কারণে অনেক শিল্প লোকসানে চলে যায়। পরে দেশে শিল্প শুরু হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দিয়ে। অনেকে স্ব-উদ্যোগে উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এতে সেবা খাতের উন্নয়ন ঘটে। আমাদের জনসংখ্যাকে আমরা সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম। কিন্তু সেটি সম্পদ হিসেবে সামনে এসেছে। এরপর জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়। এখানে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের দেশে যুগান্তকারী শিল্প হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। আশির দশক থেকেই এটি সামনে আসতে থাকে। তার আগেই এই শিল্প শুরু হয়। এই খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের একটি ভূমিকা বেশি কাজ করেছে। এনবিআর ব্যবসায়ীদের করমুক্তভাবে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আনতে দেয়। অপরদিকে রপ্তানিতে কর অব্যাহতি ও নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যারা পোশাক খাতের ব্যবসায়ী তারা রাতারাতি বড়লোক হয়েছেন। কম মজুরিতে পোশাক খাতের শ্রমিক পাওয়া যায়। এখানে বলতেই হবে, কিছু ব্যবসায়ী শ্রমিকদের বঞ্চিত করেছেন।

আপন ভুবনের এই অতিথি বলেন, আমাদের দেশের মানুষের ভোগ করার আগ্রহ বেশি। ভারতে এটি আমাদের থেকে কম। ফলে টাকা চলমান থাকে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ে। এতে দারিদ্র্য কমতে থাকে।

১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশপ্রেম ও প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে মিশে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেন জানিয়ে তিনি বলেন, এরপর দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ক্ষমতায় এসে অবকাঠামোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। বিশেষ করে জ্বালানি ও বিদ্যুতে গুরুত্ব দেন তিনি। এখানে দ্রুত উন্নতি করতে বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগকে সম্পৃক্ত করা হয় যাতে বেসরকারি অন্যান্য খাতের উন্নয়ন এগিয়ে যায়। এর ফলে বেশ কিছু ভালো মানুষের শিল্প গড়ে উঠেছে। এতে এনবিআর সহায়তা বাড়িয়ে দেয়।

অনেক ব্যবসায়ী কর অব্যাহতি নিয়ে কাঁচামাল এনে দেশের বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। কয়েকটি খাতে এটি বেশি হচ্ছে। তৈরি পোশাক খাত, কাগজ শিল্পে বন্ডের অপব্যবহার হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি, এটি বন্ধ করতে। আমরা ব্যবসায়ীদের বলছি বন্ডের অপব্যবহার বন্ধ করতে। তা না হলে একপর্যায়ে বন্ড সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হবে।

আপন ভুবনে আলাপকালে এই কর্মকর্তা বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন সরকার দেয় না। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি দেওয়া হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে কিছু বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের থেকে উচ্চ বেতন নিয়ে নিজেরা চলেন। সরকার শিক্ষাকার্যক্রমকে সহজ করেছে। তবে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করতে অর্থের দরকার। এই কাজটি এনবিআর করে থাকে। আমরা চেষ্টা করছি সরকারকে অর্থের জোগান দিতে। তবে যে পরিমাণ অর্থ দরকার সেটি জোগান দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, কর প্রদানে মানুষের অনীহা আছে। মানুষ মনে করে নিজের টাকা কেন কর হিসেবে পরিশোধ করব। সেটিতেই আমরা উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছি। বোঝাতে উদ্যোগ নিয়েছি, সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে আপনি ব্যবসা করছেন। সরকার ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি দিচ্ছে, অবকাঠামো করে দিচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশে অবকাঠামো হয় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে। কর দিয়ে ব্যবহার করতে হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের আনাচেকানাচে গেছেন। দূর-দূরান্ত তিনি চেনেন। দেশের সার্বিক উন্নয়নের চিন্তা তার মাথায়। তিনি বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আমি এনবিআর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নীতি বাস্তবায়নে কাজ করছি। বেসরকারি খাত যাতে এগিয়ে যায় সেজন্য কর ছাড় দিয়েছি। দেশীয় শিল্প সুরক্ষা দিতে অনেক ক্ষেত্রে আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কাঁচামাল আমদানিতে কর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে গেছি। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যদি আর ১০ বছর ধরে রাখতে পারি, তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই উন্নত দেশের কাতারে আসবে বাংলাদেশ। আমরা উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। সরকার কোনো লক্ষ্য বেঁধে দিয়ে থেমে নেই। সেটি অর্জনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

সরকারের ধারবাহিকতা উন্নয়নের সূচক হিসেবে কাজ করছে জানিয়ে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, এনবিআরের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মানুষের কর প্রদানে অনীহা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা মানুষের থেকে ভ্যাট আদায় করেন। কিন্তু সরকারকে পরিশোধ করেন না। মনে করেন, এটি তাদের লাভের অংশ। দেশপ্রেম, সততা জাগিয়ে তুলতে হবে। মানুষের মধ্যে ঠকানোর মানসিকতা আছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তবে সামাজিকভাবে কিছুটা সমস্যা আছে। একসময় হয়তো এটি থাকবে না। তখন দেশ আরো এগিয়ে যাবে। বিদেশের মানুষ মন্দ স্বভাব এড়িয়ে চলেন। আমরাও একদিন পুরোপুরি সভ্য হয়ে যাব।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আয়করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের সারা দেশে জরিপ চলছে। কিন্তু আমাদের কিছু লোক সম্ভাব্য আয়করদাতাদের যোগসাজশে আপসরফা করে নিচ্ছেন। এসব বন্ধ করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের করদাতার সংখ্যা ২০ থেকে ২২ লাখ। এটি বাড়িয়ে এক কোটি করা হবে। অবশ্য নির্ধারিত করদাতার বাইরে কিছু উৎস থেকে আমরা কর পাই। সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি উন্নতি করতে।

নীতি-নৈতিকতার অভাবে অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেন না জানিয়ে এই আমলা বলেন, অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে অন্য খাতে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ভালো মুনাফা করলেও ব্যাংকের দায় পরিশোধ করেন না। অনেক ব্যবসায়ী শিল্প, ঘর, বাড়ি বিক্রি করেও ব্যাংকের দায় পরিশোধ করতে পারবেন না। পরিকল্পনা করে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন না। অনেক ব্যবসায়ী দেশের বাইরে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের বাইরে প্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যবসা করে বিদেশে টাকা পাচার করছেন। ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং করে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছেন। রপ্তানি করার কথা বলে শূন্য কন্টেইনার পাঠাচ্ছেন, এমন তথ্য আছে। আমরা এসব বন্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না। জামদানির নামে গামছা রপ্তানি করে সরকারের নগদ সহায়তা নেওয়া হয়েছে। কিছু ব্যবসায়ী সব ক্ষেত্রে হাত বাড়ান, এটি কাম্য নয়। নিজের সেক্টরে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন সাবেক এই সেতু সচিব। মোশাররফ হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীদের বিলাসী জীবনও সমস্যা হিসেবে সামনে আসে। ব্যাংক থেকে ব্যবসার জন্য ঋণ নিয়ে আগে বাড়ি তৈরি করেন, দামি গাড়ি কেনেন। এসব অবক্ষয় আমাদের দেশে আছে। যে পরিমাণ কর দেওয়ার কথা সেটিও দেন না। এতে সরকারের উদ্যোগ ব্যাহত হয়। সবাইকে নিজের কাজের ভেতরে দেশপ্রেম দেখাতে হবে। এখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতি হচ্ছে সংঘবদ্ধভাবে। ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের সুবিধার কারণে রাজস্ব বোর্ডের কর্মচারীদের সঙ্গে জোগসাজশ করে থাকেন। আমরা সরকারি চাকরি করে বুঝতে পারি, দুর্নীতি কীভাবে হচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। ঋণগ্রহীতারা ইতিবাচকভাবে নিলে উদ্যোগ সফল হবে।

পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে সাবেক এই সেতু সচিব বলেন, আমার আর এটি নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই। কারণ প্রধানমন্ত্রী আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। আমার সব ভালো কাজে উৎসাহ দিয়েছেন। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে সম্পৃক্ত করতে। সরকারকে উৎখাতের চিন্তা ছিল এর পেছনে। আমাদের জন্য আশীর্বাদ, বিশ্বব্যাংক ছাড়া আর দুটি অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে একমত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মাথানত করেননি। তাই এত বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করে নিজেরাই করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংক এখন কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই অর্থ জোগান দিচ্ছে।

এ সময় বাংলাদেশের খবরের সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, বাংলাদেশের খবর মাতৃভূমি, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও উন্নয়ন— এই চার প্রশ্নে কোনো আপস করবে না কারো সঙ্গে। উপদেষ্টা সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন বলেন, দুর্নীতির কারণে যাতে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads