• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
আলোচিত হত্যাকাণ্ড

সংগৃহীত ছবি

বিশ্লেষণ

সালতামামি - ২০১৯

আলোচিত হত্যাকাণ্ড

  • এ এইচ এম ফারুক
  • প্রকাশিত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯

প্রতিদিন সূর্যাস্ত হয় নতুন ভোরের অঙ্গীকার নিয়ে। তবে আজ যে সূর্যাস্ত হবে তা এ বছর আর উদয় হবে না। আগামীকাল নতুন সূর্যাদয় হবে নতুন বছরের, নতুন ভোরের বার্তা নিয়ে। কিন্তু নানা শুভকাজের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকার পাশাপাশি বিদায়ী ২০১৯ সালে সংঘটিত কিছু অশুভকাজ কালোছায়া ফেলবে দেশবাসীর মনে। এর মধ্যে ফেনীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, বরগুনায় রিফাত শরীফ নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে ক্যাম্পাসে পিটিয়ে হত্যা, দীর্ঘ বছরপর ডাকসুর নির্বাচন ও ভিপি নুরুল হকের ওপর সিরিজ হামলা এবং ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান উল্লেখযোগ্য।

নুসরাত, রিফাত শরীফ ও আবরার হত্যা

এ বছর তিনটি হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে। এগুলো ছিল- ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যা, ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা এবং ৭ অক্টোবর ঢাকায় বুয়েটে শেরে বাংলা আবাসিক হলের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা।

নুসরাত জাহান রাফির শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ৪ দিন পর ১০ এপ্রিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ঘটনার ৭ মাসেরও কম সময়ে গত ২৪ অক্টোবর ফেনীর স্থানীয় আদালতে বিচারকাজ শেষ হয় নুসরাত হত্যার। বিচারিক আদালতে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ মামলার ১৬ আসামিরই ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান সন্তোষ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়াগুলো দ্রুত শেষ করার দাবি জানান তিনি।

গত ২৬ জুন সকাল সোয়া ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা স্ত্রীর সামনে রিফাত শরীফ নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখসহ পাঁচ-ছয়জনকে অজ্ঞাত আসামি করে বরগুনা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে তদন্ত শেষে ১ সেপ্টেম্বর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। একই সঙ্গে রিফাত হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ৩ অক্টোবর বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজী এ মামলার পলাতক আট অভিযুক্তের মালামাল জব্দের নির্দেশ দেন। আদালত আগামীকাল ১ জানুয়ারি অভিযোগ গঠনের শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেন। সে অনুযায়ী আগামীকাল অভিযোগ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

গত ৭ অক্টোবর বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে। আবরারকে হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন।

ওইদিন বুয়েটের শেরে বাংলা আবাসিক হল থেকে আবরার ফাহাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তাকে রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পিটিয়ে ও নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগে মামলা হয় ২৫ জনের বিরুদ্ধে। ঘটনার মাস খানেক পরেই মামলার ২৫ জনকেই অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। অভিযুক্তদের বেশির ভাগই বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলেন। আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদ, বিচার ও অন্যান্য দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে বুয়েট প্রায় এক মাস সময় ধরে অচল থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে ওই বিশ্ববিদ্যারয়ে ছাত্র রাজনীতিই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া বুয়েট প্রশাসন অভিযুক্ত ছাত্রদের অনেকের ছাত্রত্ব বাতিলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শাস্তি দেয়। আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুনও ছেলে হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করেন।

সর্বশেষ চলতি বছরের ১২ অক্টোবর সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলায় ছয় বছরের শিশু তুহিনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বাড়ির কিছু দূরে মসজিদের পাশে একটি গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়। লাশ উদ্ধারের সময় তার পেটে দুটি ছুরি গাঁথা ছিল। তার কান ও প্রজনন অঙ্গও কেটে নেওয়া হয়। প্রাথমিক তদন্ত শেষে জেলা পুলিশ সুপার দাবি করেন, চার বছর আগের একটি হত্যা মামলায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে তুহিনের বাবা আবদুল বাছির, চাচা আবদুল মছব্বির, জমশেদ মিয়া, নাছিরসহ কয়েকজন ওই হত্যাকাণ্ড ঘটান। তবে নিহতের পরিবার বরাবরই এ দাবি অস্বীকার করে আসছে। ফলে এখনো তুহিন হত্যার কারণ জানা যায়নি। এ বিষয়ে দিরাই থানার ওসি কে এম নজরুল ইসলাম জানান, এখনো তদন্ত চলছে। প্রাথমিকভাবে হত্যাকাণ্ডে পরিবারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

ডাকসু নির্বাচন ও একজন ভিপি নুরুল হক নুর

২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত ১১ মার্চ। এ নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে নানা শঙ্কাও ছিল। তবে নির্বাচনে মেরূকরণটা ছিল ভিন্ন রকম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদলকে ছাড়িয়ে নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভাব ঘটে কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে আন্দোলনকারী ফোরামের। নির্বাচনে ছাত্রলীগের সে সময়ের সভাপতি রেজওয়ানুল হককে পরাজিত করে ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন কোটা আন্দোলনের নেতা হিসেবে পরিচিত সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী নুরুল হক নুর। তবে ডাকসুর জিএসসহ অন্য পদগুলোতে বিজয়ী হন ছাত্রলীগের প্রার্থীরা।

ভিপি পদে পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি ছাত্রলীগ। নুরুল হক ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর বেশ কয়েকবার হামলার ঘটনা ঘটে তার ওপর। আর প্রত্যেকবারই হামলার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ গত ২২ ডিসেম্বর নুরের ওপর যে হামলা হয় সে হামলার পেছনেও ছাত্রলীগের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় নুরুল হকসহ কমপক্ষে ছয়জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান

নানা ইস্যুর মধ্যে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে চাঁদাবাজির অভিযোগে সরিয়ে দেওয়ার পর সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে ৪ সেপ্টেম্বর। সে অভিযানে একের পর এক ক্লাব ও বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থায় অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য ধরা পড়ে। অভিযানের ফলে ঢাকার এসব ক্লব বন্ধ থাকে লম্বা সময় ধরে।

পরে র্যাব অভিযান চালিয়ে যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি (পরে বহিষ্কৃৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ সংগঠনটির বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় কৃষকলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগেরও কয়েকজন নেতাকে। ক্লাবগুলোতে এবং বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়িতে এই অভিযানে লাখ লাখ টাকাও উদ্ধার করা হয়। ফলে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের অনেকের মধ্যে এই অভিযান নিয়ে একটা ভীতি সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে এটাকে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে নিজেদের সংগঠনগুলোতে ‘শুদ্ধি’ অভিযান আখ্যা দেন।

এ সময় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, জনগণের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরের বাইরে কীভাবে এসব ক্যাসিনো চলেছে? তখন তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানার পর তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে  আলোচনা করেছেন এবং তার ভিত্তিতে এই অভিযান চালানো হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads