• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

বিশ্লেষণ

হুঙ্কার আর অঙ্গীকারেই ফুরাল ৩৬৫ দিন

  • আফজাল বারী
  • প্রকাশিত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯

‘আরেকটা থাপ্পড় দিয়ে দেখ, কী করি! সাহস থাকলে আরেকটা দিয়ে দেখ!!’ দু’দফায় চপেটাঘাতের শিকার ব্যক্তিটি বীরদর্পে হুঙ্কার দিল- আমাদের এলাকায় আসিস, দেখিয়ে দিব। এরপরও ঘটেছে ঘটনা। নির্যাতিত বেচারা চার দেয়ালের ভেতরে বসে শুধু হুঙ্কার দিয়েই দিন, মাস ও বছর পার করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বেসরকারি সংস্থা এবং সংবাদ সংগ্রহ করা বিটের সংবাদকর্মীদের দৃষ্টিতে বছরের ৩৬৫ দিনই এমন হুঙ্কার দিয়ে পার করেছে রাজনৈতিক দল বিএনপি। একাধিকবার সরকার পরিচালনায় এবং সংসদে বিরোধী দলে ছিল। এখন রাজপথের। দলটির প্রধান কান্ডারি কারাবন্দি, দ্বিতীয়জন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে অবস্থান করছেন দেশের বাইরে, সিনিয়রিটির ক্রমানুসারে অবশিষ্টরা আপন প্রাণ বাঁচাতে এবং বিত্ত রক্ষায় চরম কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন। অথচ কেন্দ্রীয় নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- চেয়ারপারসনের মুক্তি না হলে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করবেন তারা। এখন কর্মসূচির দিনে বাণিজ্যিক চেম্বারে বসে টেলিভিশনে খবর দেখেন-শোনেন আর ইন্টারভিউ দেন। রাজপথ ছেড়ে এসিযুক্ত ঘরে অবস্থান নেওয়ার ফলে বিএনপির টালিখাতায় প্রাপ্তির অঙ্ক শূন্য। দলীয় কোষাগারে জমা হয়েছে সাধারণ কর্মীদের ক্ষোভ, হতাশা, সিনিয়র নেতাদের প্রতি অনাস্থা, অবিশ্বাস। ঘরে ঘরে মামলার এফআইআরের স্তূপ হয়েছে। কথায় কাজে বিশাল ফারাকের পথচলা নিয়ে হাস্য-রসে ব্যঙ্গ করছে সাধারণ জনতা। দলটির নেতাদের দেখলেই সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করেন- খালেদার মুক্তির জন্য কবে নামবে বিএনপি? কোন ঈদের পর? শীত না গ্রীষ্মে? বর্ষায় নাকি খরায়?

দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা ছিল বিএনপির চলমান অঙ্গীকার বা শপথ। প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা শপথ গ্রহণ করতেন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য। কখনো বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে, কখনো দলীয় কার্যালয়ের সামনে প্রয়াত নেতার জানাজায় আবার কখনো ভাড়া করা চার দেওয়ালের ভেতরেই এ শপথ নিয়েছেন তারা। মাসের পর মাস গেল কিন্তু অঙ্গীকার বাস্তবায়ন দেখছে না নেতাকর্মীরা। ২০১৯ সালটা বিএনপি শুরুই করেছে আন্দোলনের হুমকি দিয়ে। শুরুতেই বিএনপির সামনে ইস্যু ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বছর শুরুর আগেরদিন আগে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বছরজুড়ে বিরোধী রাজনীতিতে আলোচনায় ছিল ‘বিতর্কিত’ একাদশ সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনোত্তর কিংবা বছরজুড়ে এই ইস্যুতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বিরোধীরা। কেবল মুখেই হুঙ্কার দিয়েছে। অবিলম্বে খালেদা জিয়ার মুক্তি আর পুনরায় নির্বাচন না দিলে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তোলা হবে।

কখনো ভোট ডাকাতির নির্বাচন কিংবা মধ্যরাতের নির্বাচন বলে তারা রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা করেছে। কর্মসূচি ছিল কাগুজে। বলতে গেলে মাঠে তেমন কিছুই ছিল না। দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা সরকারের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছেন। বলেছেন-সরকার বছর পার করতে পারবে না। সরকারের হাতে সময় বেশি নেই। বিদায় ঘণ্টা বাজবেই। যে কোনোদিন সরকারের পতন। 

অন্যদিকে ওই নির্বাচনে ৭৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারও ছিল নির্বিকার। গত একবছরে নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের উচ্চবাচ্য পাত্তাই দেয়নি। বরং সরকার দিনকে দিন আরো পাকাপোক্ত হচ্ছে। ক্ষমতার ভিত আরো বেশি মজবুত ও প্রলম্বিত করার লক্ষ্যে সামনে এগুচ্ছে তারা। পাশাপাশি উন্নয়নের স্লোগানকে আরো ছড়িয়ে দেয়ার কৌশলী পথে হাঁটছে। 

একাদশ সংসদ নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ৮২ শতাংশ আসন লাভ করে। অন্যদিকে বিএনপি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ আসন পায়। নির্বাচনের এই ফলাফল বিরোধী জোট বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের জন্য ছিল চরম অনাকাঙ্ক্ষিত ও অভাবনীয়। যদিও বিরোধীদের জন্য খারাপ ফলাফল হতে যাচ্ছে, এমন লক্ষণ নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতি বা আভাস ইঙ্গিত ছিল।

২০১৮ সালের ৯ থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে ৪৭টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যার মধ্যে ৮ জন ব্যক্তি নিহত হন ও ৫৬০ জন আহত হন। বিএনপি অফিসের দেওয়া তথ্যানুসারে, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত বিরোধী দলগুলোর (যাদের অধিকাংশ বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিশ দলীয় জোটের নেতাকর্মী) ওপর ২ হাজার ৮৩৩টি হামলা হয়েছে। এতে ১২ হাজার ৯২৩ জন আহত হয়েছেন। নির্বাচনের আগের মাস ৮ নভেম্বর থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপির নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় ১ হাজার ৫৭৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একই সময়ে ১৫ হাজার ৫৬৮ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। একটি ইংরেজি পত্রিকার তথ্য অনুসারে তথ্যানুসারে, ১০ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৫৬ জন প্রার্থী (যাদের অধিকাংশ বিএনপির) হামলার শিকার হয়েছেন, ১ হাজার ১৯০ জন আহত হয়েছন ও ৮০০ বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন সহিংসতায় বিভিন্ন জেলায় ১৫ জন নিহত হন। বিরোধীদের জন্য এরকম একটি প্রতিকূল অনুষ্ঠিত হয়েছে একাদশ সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের দিনই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানান। ওইদিন তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় ভোট ডাকাতি হয়েছে। অবিলম্বে এই প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করতে হবে। সেই সঙ্গে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনঃনির্বাচন দিতে হবে। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চরম ভরাডুবির পর দলের বেশকিছু প্রার্থী বিশেষ নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মোট ৭৪টি মামলা দায়ের করে। যদিও আজ পর্যন্ত এসব মামলার শুনানি হয়নি। নির্বাচনের কয়েক মাসের মাথায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে গুরুতর অভিযোগ তুলে টিআইবি। তারা ৫০টি আসন নিয়ে গবেষণা করে ৩৩টিতে ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল দেয়ার অভিযোগ পেয়েছে বলে দাবি করে। টিআইবি ২৯৯ আসনের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি আসনে গবেষণার যে তথ্য দিয়েছে, তাতে গড়ে ৯৪ শতাংশ আসনে নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে। জাল ভোট পড়েছে ৮২ শতাংশ আসনে। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটবাক্সে সিল মারা হয়েছে ৬৬ শতাংশ আসনে।

নির্বাচনোত্তর গত একবছর সাদামাটাই কেটেছে। বিএনপি চেয়াপরপারসনের কারামুক্তির দাবি নিয়ে ব্যস্ত ছিল বিএনপি। শত চেষ্টা করেও দলটি আইনি লড়াইয়ে দলের প্রধানকে এখনো মুক্ত করতে পারেনি। উল্টো সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের মাধ্যমে মুক্ত হওয়ার শেষ সুড়ঙ্গও বন্ধ করে দিয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীরা বছরজুড়ে আশায় আশায় ছিল এই রায়ে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) জামিন পাবেন, এবার না হলেও পরের রায়ে ম্যাডামের জামিন হবেই। বছর শেষে উচ্চ আদালতে যেখানে প্রধান বিচারপতির হাতে ছিল জামিনের প্রসঙ্গটি তাতেও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এখন আপাতত আশা ছেড়ে দিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছেন আর দোয়া চেয়েছেন তার (খালেদা জিয়া) বেঁচে থাকার জন্য। 

নির্বাচনে অভাবনীয় ফলাফলের পর নির্বাচিত ৮ এমপির শপথ না নেয়া এবং পরবর্তী সময়ে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে তারা আটল থাকতে পারেনি। একপর্যায়ে নির্বাচিত এমপিদের শপথ নেয়ার পাশাপাশি পরবর্তীতে সব নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads