• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

জীব ও পরিবেশ

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় লঙ্ঘন হচ্ছে ‘প্রাণি অধিকার’

  • প্রকাশিত ১৯ এপ্রিল ২০১৮

ফরহান অভি, চট্টগ্রাম

কিছুক্ষণ পরপরই বালি উড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভোঁ-দৌড় দিচ্ছে জেব্রাগুলো। তবে থেমে যেতে হচ্ছে মুহূর্তেই। কারণ তাদের জন্য বরাদ্দ পরিসর খুবই সীমিত। অন্যদিকে ছোট্ট কামরায় বন্দি দুটি উটপাখি- যার মেঝেতে অর্ধেক টাইলস আর বাকি অর্ধেক বালি। টাইলসে ঠোকর কেটেই রাত-দিন পার করছে উটপাখিগুলো। চিত্রা হরিণগুলোর জন্য বরাদ্দ ছোট্ট উঠোনে নেই তাদের বসবাস উপযোগী মাটি ও ঘাস, আছে তপ্ত বালি। তাতে চৈত্রের এই প্রখর তাপে হাঁসফাঁস করছে পশুপাখি। এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থান করছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় আবদ্ধ একসময়ের অরণ্যচারী প্রাণী।

১৯৮৯ সালে স্থাপিত এ চিড়িয়াখানায় বর্তমানে ৬৭ প্রজাতির তিন শতাধিক প্রাণী রয়েছে। তাদের জন্য বরাদ্দ স্থান খুবই অপ্রতুল। ছোটাছুটি, স্বভাবসুলভ আনন্দে মেতে উঠতে না পারায় তাদের স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ও খাদ্যাভ্যাসে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এসব পশুপাখি অসুস্থ হওয়ার পাশাপাশি কমে যেতে পারে তাদের আয়ুষ্কাল- এমনই আশঙ্কা প্রাণী বিশেষজ্ঞদের।

কেবল জেব্রা, চিত্রা হরিণ, উটপাখিই নয়, সিংহ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং ভাল্লুককেও রাখা হয়েছে চিড়িয়াখানার সঙ্কীর্ণ পরিসরে। মাত্র ছয় একর এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এ চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের জন্য বরাদ্দ আছে প্রয়োজনের চেয়ে তিন-চারভাগ ছোট আকারের কামরা ও উন্মুক্ত স্থান। স্থায়ী খাঁচাগুলো অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হওয়ায় প্রাণীদের জন্য নির্ধারিত উন্মুক্ত স্থানে নেই পর্যাপ্ত ছায়ার ব্যবস্থা। এ ছাড়া হরিণ, জেব্রাসহ তৃণভোজী প্রাণীগুলোর জন্য নির্ধারিত উঠোনে রয়েছে মাটির পরিবর্তে বালি। বালির উঠোনে জন্মে না ঘাস ও লতাপাতা।

regular_1830_news_1524069922

বিশেষজ্ঞদের মত, প্রাণীগুলো ছোটাছুটির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা না পেলে তাদের স্বভাব পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে তারা ঠিকমতো খাবার গ্রহণ করে না। তৃণভোজী প্রাণীদের হাঁটাচলার জন্য মাটির ওপর থাকতে হয় সবুজ ঘাস। অন্যথায় বিপন্ন হতে পারে তাদের জীবন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, বিদেশি পশু আনার আগে এই পরিবেশে তাদের টিকে থাকার সক্ষমতা যাচাই জরুরি। সেই সঙ্গে তাদের ছুটে বেড়ানো নিশ্চিত করার মতো জায়গাও নির্ধারণ করতে হবে। দুইশ’ থেকে চারশ’ কেজি ওজনের প্রাণী জেব্রা। দৌড়ানো তাদের অভ্যাস। নির্দিষ্ট একটি গতি তোলার আগে থামতে চায় না তারা। কিন্তু চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় বিদেশি এসব প্রাণী এনে তাদের আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। এতে ‘অ্যানিমেল রাইটস’ (প্রাণী অধিকার) লঙ্ঘন হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ছোটাছুটির পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে এসব প্রাণীর শারীরিক বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং আয়ু কমে যাবে। ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ থাকায় একটি অপরটির প্রতি হিংস্র ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সভায় আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম, কোটি টাকায় এসব বিদেশি প্রাণী না এনে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় পশুপাখি চিড়িয়াখানায় সংরক্ষণ করা উচিত।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার চিকিৎসক ডা. শাহাদাত হোসাইন শুভ জানান, দুটি উটপাখিকে রাখা হয়েছে ৫০ বর্গমিটার জায়গায়। ছয়শ’ বর্গমিটার জায়গায় থাকতে হচ্ছে দুটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে। একই পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ সিংহের জন্যও। ১২টি চিত্রা হরিণ চরছে তিন হাজার বর্গমিটার জায়গার ভেতর। তিনশ’ বর্গমিটার জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে দুটি ভাল্লুক। ছয়টি জেব্রার জন্য বরাদ্দ আছে পাঁচ হাজার বর্গমিটার জায়গা। তিনি জানান, এসব প্রাণীর জন্য ন্যূনতম যেটুকু জায়গা প্রয়োজন চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এখনো তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ছয়টি জেব্রার জন্য অন্তত ১৫ হাজার বর্গমিটার জায়গা প্রয়োজন। উটপাখির জন্য দরকার এক হাজার মিটার। পাঁচ হাজার মিটার করে জায়গা দরকার দুটি বাঘ ও দুটি সিংহের জন্য। ১২টি চিত্রা হরিণের জন্য দরকার কমপক্ষে ৯ হাজার বর্গমিটার। ভাল্লুক দুটির জন্য দরকার কমপক্ষে ১২শ’ বর্গমিটার জায়গা।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার রুহুল আমীন বলেন, পাহাড়ঘেরা চিড়িয়াখানাটির ছয় একর জমির মধ্যে দুই থেকে আড়াই একর সমতল। চিড়িয়াখানার পরিসর আর বাড়ানো সম্ভব নয়। তাই প্রাণীদের সর্বোচ্চ জায়গা দিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, যা সাফারি পার্ক হলে করা যেত। সাফারি পার্ক বিশাল এলাকা নিয়ে স্থাপিত হওয়ায় সেখানে একপ্রকার মানুষকে বন্দি রেখে প্রাণীগুলোকে উন্মুক্ত রাখা হয়।

এ ছাড়া পুরো এলাকাটিই বালিসমৃদ্ধ হওয়ায় সেখানে মাটি নেই। তবুও বাইরে থেকে মাটি এনে দেওয়া হচ্ছে। এরপরও জেলা প্রশাসন এসব প্রাণীর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads