• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

শ্বাসমূলে বালু জমে মরে যাচ্চে সমুদ্রসৈকতের গাছ

ছবি : বাংলাদেশের খবর

জীব ও পরিবেশ

বিলীনের শঙ্কায় টেংরাগিরি

  • শাহনেওয়াজ খান
  • প্রকাশিত ২৬ মে ২০১৮

টেংরাগিরি (বরগুনা) থেকে ফিরে

সংরক্ষিত বনাঞ্চলই শুধু নয়, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যও; আছে বন বিভাগের কার্যক্রম। তারপরও বিলীন হওয়ার শঙ্কায় বরগুনার সাগরপাড়ে টেংরাগিরি বনাঞ্চলের বড় একটি অংশ। বিরূপ প্রকৃতি ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় মরছে গাছ। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। বাজেটের অভাবে বন রক্ষায় সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছে না বন বিভাগ।

বরগুনার তালতলী উপজেলা থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত বিস্তৃত বনটির বর্তমান আয়তন ৪০৪৮ দশমিক ৫৮ হেক্টর (প্রায় ১০ হাজার ৪ একর)। সরকারিভাবে একে ‘টেংরাগিরি বনাঞ্চল’ বলা হলেও স্থানীয়ভাবে এটি ‘ফাতরার বন’ নামে পরিচিত। ১৯৬০ সালে তৎকালীন সরকার এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর এই অঞ্চলকে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

লবণাক্ত ও মিষ্টিপানির মিশ্রণে এই বনাঞ্চলে রয়েছে ছোট-বড় বিভিন্ন খাল। এগুলোতে সারা বছরই জোয়ার-ভাটায় পানির প্রবাহ থাকে। বনে রয়েছে সুন্দরী, কেওড়া, বাইন, পশুর, কাঁকড়া, রেইনট্রি, জারুল, ধুন্দল, বনকাঁঠাল, বট, তেঁতুল, গেওয়া, করমচা, গরান, শিংড়া, হাররা, হেতাল, গিলালতা, কালিয়ালতা, বলাই, হারগোজা, গোলপাতাসহ অসংখ্য প্রজাতির গাছগাছড়া। বানর, শূকর, শজারু, শেয়াল, বাদুড়, কুকুর, বেজি, চামচিকা, গুইসাপ, গোখরা, অজগর, বাবুই, পেঁচা, বউ-কথা-কও, চিল, শালিক, শ্যামা, টুনটুনি, ঘুঘু, মাছরাঙা, সাদাবক, ডাহুক, দোয়েল, বুলবুলি ইত্যাদিসহ রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির বন্যপ্রাণীও। কিন্তু গাছ ও বন রক্ষায় প্রশাসনের উদাসীনতায় হারিয়ে যেতে বসেছে সব।

টেংরাগিরিতে গাছ মরার মূল কারণ শ্বাসমূলে বালু জমে যাওয়া ও ভূমিক্ষয়। প্রবল ঢেউয়ে উপকূলে পাড় ভাঙছে, গাছের গোড়ার মাটি ও বালু সরে গিয়ে শিকড় শুকিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া পলি হিসেবে আসা বালু শ্বাসমূল ঢেকে দেওয়ায় মরে যাচ্ছে গাছগুলো। সোনাকাটা সৈকতের বালিয়াড়িতে অসংখ্য মরা রেইনট্রি, কেওড়া ও ছৈলাগাছ দেখা যায়। আরো অনেক গাছ মৃতপ্রায়। অসংখ্য গাছের গোড়ার মাটি সরে গিয়ে শিকড়বাকড় দৃশ্যমান। সংরক্ষণের অভাবে পড়ে থাকা গাছগুলো বালুতে ঢাকা পড়েছে। নোনাপানির সংস্পর্শে নষ্ট হয়ে গেছে মূল্যবান এসব বৃক্ষ। বন বিভাগের হিসাবে, টেংরাগিরি বনের ২১ কিলোমিটার জুড়ে চলছে তীব্র ভূমিক্ষয়। এতে গত ১০ বছরে বনের আয়তন কমেছে প্রায় চার কিলোমিটার।

বন বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো শ্বাসমূলীয় বনের গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তর আছে। শুরুতে উপকূলে ভূমি গঠনের পর উড়িগাছ জন্মায়, তারপর ভূমি কিছুটা শক্ত হলে উড়িগাছ মরে গিয়ে কেওড়া-গেওয়া জন্মায়। মাটি আরো শক্ত হলে আগের গাছগুলো মরে গিয়ে সেখানে সুন্দরী, গরানসহ অন্যান্য গাছ জন্মে।

টেংরাগিরি বনাঞ্চলে গাছ মরে যাওয়া বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অধ্যাপক মোহাম্মদ দানেশ মিয়া বলেন, ‘এটা প্রাকৃতিক কারণে হচ্ছে। ভূমির পরিস্থিতি বদলানোর কোনো ব্যবস্থা নেই।’ তবে ভূমিক্ষয় রোধ ও অন্যান্য বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেন তিনি।

এ বিষয়ে কথা হয় উপ-বন সংরক্ষক জহির ইকবালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি ও পলি হিসেবে আসা সিলিকন বালুর নিচে চাপা পড়ে কেওড়া গাছগুলোর শ্বাসমূল প্রয়োজনীয় সংশ্লেষ করতে পারছে না। এ কারণে সৈকতে অবস্থিত গাছগুলো মরে যাচ্ছে। এটা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। পরিবেশের অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতিও বদলাবে।’ এক্ষেত্রে তিনি সুন্দরবনের কটকায় কেওড়া গাছগুলোর একই কারণে মরে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন।

তবে গাছগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সৈকতে ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় স্থানে বাঁধ ও অন্যান্য কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী বনাঞ্চলগুলোতে এ কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান বন অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা। এত দেরিতে কেন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে- এ ব্যাপারে তিনি বাজেট সঙ্কটকে দায়ী করেন। পর্যাপ্ত অর্থ না পাওয়ায় দ্রুত ও প্রয়োজনের সময়ে ইচ্ছা থাকলেও এসব কাজ করা সম্ভব হয় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অবৈধভাবে গাছ কাটা অব্যাহত রয়েছে। এর ফলেও বনাঞ্চল অনেকটা হুমকির মধ্যে রয়েছে। স্থানীয়দের গাছ কাটার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সরাসরি তা অস্বীকার করেননি জহির ইকবাল। তিনি বলেন, অনেক চেষ্টা করেও কিছু অসাধু মানুষকে এ ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা যায় না। তবে গাছ চুরি ঠেকাতে বন বিভাগ সব সময় তৎপর বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

লোকবল ও যথাসময়ে উদ্যোগের অভাবের কথা উল্লেখ করেন বরগুনার তালতলী রেঞ্জের সখিনা বিটের কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন প্রামাণিকও। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে গাছ চুরির ঘটনা অনেক কমে এসেছে। মূলত মরা গাছগুলোই স্থানীয় লোকজন কেটে নিয়ে যায়।’ তবে পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলের সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অজিত কুমার রুদ্র জানান, সৈকতের অংশে মরা গাছগুলো কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে বঙ্গোপসাগরের পাড় ভাঙন কিছুটা হলেও রোধ করা যাবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads