• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
চীন-ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যর চেষ্টা নেপালের

সম্প্রতি বেইজিং সফরকালে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের সঙ্গে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি

ছবি : ইন্টারনেট

এশিয়া

চীন-ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যর চেষ্টা নেপালের

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ০৭ জুলাই ২০১৮

চীনের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক সঠিক পথে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্থায়িত্ব ও সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সত্ত্বেও কাঠমান্ডুর সঙ্গে তিব্বতকে সংযোগকারী প্রস্তাবিত রেলওয়ে প্রকল্পটির পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেছেন তিনি। প্রকল্পটির বাস্তবতা ও সাধারণ নেপালি ট্রেনযাত্রীদের ব্যয়-সাশ্রয় নিয়ে এক ব্যবসায়ীর প্রশ্নের জবাবে বেশ কঠোরভাবেই ওলি বলেছেন, ‘রেলওয়ে প্রকল্পটির বিরোধিতা করার সাহস করবেন না।’
সাউথ এশিয়ান মনিটরের প্রতিবেদক যুবরাজ ঘিমাইর জানিয়েছেন, গত ২৪ জুন সমাপ্ত ওলির ছয় দিনের বেইজিং সফরকালে নেপাল ও চীন ১৪টি বহুমুখী চুক্তিতে সই করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে তিব্বত থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত সিগাতসে-কিরঙ রেললাইন সম্প্রসারণ, চীন ও নেপালের বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহিত করা ও প্রথমবারের মতো আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ।

দুই পক্ষের মধ্যে গ্রেট হলে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগে ওলি ও শি ২০ মিনিট একান্তে আলোচনা করেন। ওলি বেইজিং গিয়েছিলেন ১১৭ সদস্যের দল নিয়ে। নেপাল-চীন ৬৩ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসে কোনো নেপালি সরকারপ্রধান এবারই বৃহত্তম দলের নেতৃত্ব দিলেন। এই সফর থেকে কিংবা চীনের কাছ থেকে প্রত্যাশা যে নজিরবিহীন উচ্চতায় ছিল, এটিও তার একটি প্রমাণ।

তাছাড়া ওলি জানিয়েছেন, পারস্পরিক আস্থা প্রশ্নে আরো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের জন্য চীনের সিপিসি ও নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচন্ডের সাথে তিনি এই দলের প্রধান) মধ্যে ভ্রাতৃত্বপ্রতীম সম্পর্ক রক্ষা করা জরুরি।

দুই কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ‘ভ্রাতৃত্বপূর্ণ’ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলার আরো বড় রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। কারণ নেপালের প্রধান রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতারা ভারতের প্রভাবে থাকার সিলমোহর এঁটে থাকেন। ২০০৬ সালের পর থেকেই দেশটির ঘরোয়া রাজনীতিতে এমনটা চলছিল। ওই সময়ই রাজতন্ত্রবিরোধী প্লাটফর্মে মাওবাদী (তখন পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল) ও সাতটি গণতন্ত্রপন্থী দলের মধ্যে ভারত সফলভাবে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল।

চীন ঐতিহ্যগতভাবে নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে উদাসীন ছিল। তারা তাদের স্বার্থ ও সংশ্লিষ্টতা সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তারা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকার গঠন নিয়ে দৃশ্যত সন্তুষ্ট।

ওলিকে স্বাগত জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে শি বলেন, চীন সফলভাবে ১৯ম সিপিসি জাতীয় কংগ্রেস আয়োজন করেছে, দল ও দেশের নতৃন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। নেপালও নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করেছে। নতুন উন্নয়ন সুযোগে এটি হবে নতুন ঐতিহাসিক যাত্রা।

নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে মন্তব্য না করার ঐতিহ্য বজায় রাখা সত্ত্বেও শি বলেন, জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা সমুন্নত রাখা এবং জাতীয় পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিকব্যবস্থা ও উন্নয়ন পথ স্বাধীনভাবে বাছাই করার অধিকার বজায় রাখার নেপালি প্রয়াসের প্রতি চীন সমর্থন দেবে।

মোটামুটিভাবে নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত প্রেসিডেন্ট শির কথায় আগামীতে নেপালে ভারতের বিরুদ্ধে চীনকে কিছু সুবিধা প্রদান করার কাঠমান্ডুর স্বাধীনতা অব্যাহত রাখার প্রতি সমর্থন পাওয়া যায়।

দেশে ফিরে নেপালি পার্লামেন্টকে ওলি বলেন, দুই পক্ষ শিগগিরই ২০১৬ সালের মার্চে ভারতীয় অর্থনৈতিক অবরোধকালে তার বেইজিং সফরকালে সই হওয়া ট্রানজিট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (টিএফএ) চূড়ান্ত করবে।

টিএফএ নেপালকে চীনের মাধ্যমে সাগরে প্রবেশের সুযোগ দেবে। এর ফলে ভারতের ওপর নির্ভরশীল না থাকার বিকল্প পথের খোঁজ পাওয়া যাবে। অবশ্য ভারতের সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে ওলি বলেন, নেপাল তার কোনো প্রতিবেশীকে অপরের বিরুদ্ধে খেলাবে না।

তবে ওলির বেইজিং সফর সফল হয়েছে বলেই ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়ে থাকে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর ফ্রি তিব্বত কার্যক্রম নিয়ে সংশয়ে থাকার কারণে দৃশ্যত চীন পারস্পরিক প্রত্যাবর্তন চুক্তি করতে চেয়েছে। চীনের ধারণা, পাশ্চাত্য দেশগুলোর গণতন্ত্রপন্থী আইএনজিগুলোর মাধ্যমে ফ্রি তিব্বত কার্যক্রমে ইন্ধন দেওয়া হয়ে থাকে।

ভারতের উদ্যোগে মাওবাদী ও সাত-দলীয় জোটের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছিল তার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ছিল ভারত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের। এখন বিশ্লেষকদের মনে যে প্রশ্ন ঘুরপাঁক খাচ্ছে তা হলো ওলি কিভাবে নিকট প্রতিবেশী এবং নেপালে বড় ধরনের স্বার্থ থাকা পাশ্চাত্য দেশগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করবে? ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ বিবেচিত এনজিওগুলোকে অ-চীনা বিশ্ব বিপুল আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

ঘটনাক্রমে ওলি যখন চীন ছিলেন, তখন স্ত্রীর মেডিক্যাল চেক-আপের কথা বলে সিপিএনের কো-চেয়ারম্যান মাওবাদী নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ড সিঙ্গাপুরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রচন্ড দেশে ফিরেছেন ১ জুলাই।

‘মেডিক্যাল তীর্থযাত্রার’ জন্য নেপালি নেতাদের পছন্দের জায়গা ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুর। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে পর্দার আড়ালে মতবিনিময়ের জন্যও স্থান দুটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, উত্তর দিকে নেপালের দ্রুত যাত্রা ‘অবশ্যই বন্ধ’ করতে হবে।

প্রচন্ডকে পাঁচ বছর মেয়াদের তিন বছর পর ব্যাপকভাবে ওলির উত্তরসূরি বিবেচনা করা হচ্ছিল (দুই কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এ নিয়ে গোপন সমঝোতায় বিষয়টি ছিল)। কিন্তু চীন পরোক্ষভাবে ওলির নেতৃত্বকে ‘স্থিতিশীলতা’ সৃষ্টিকারী উপাদান এবং নেপালের বর্ধিত সহযোগিতার ভিত্তি হিসেবে অভিহিত করায় প্রচন্ডের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ সৃষ্টি হয়েছে।
ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল-ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট ও প্রচন্ডের নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির একীভূত হয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল গঠনের ব্যাপারে ভারত পুরোপুরি অন্ধকারে থাকলেও দুজনের মধ্যে ঐক্য-প্রক্রিয়ায় চীন বারবার সম্পৃক্ত হয়েছে।

নেপালে চীনের বিনিয়োগ ও অন্যান্য স্বার্থ, ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকায় দেশটিতে একটি স্থিতিশীল ও বন্ধুপ্রতীম সরকার কামনা করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে।

ভারতের তুলনায় নেপালে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য অবস্থানও আছে চীনের। গৃহীত প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করার সামর্থ্যও আছে চীনের। তবে আগামী দিনগুলোতে প্রকল্পগুলোর আকার, বাজেট ও সংখ্যা বাড়তে থাকলে কী হবে তা এখনো অপরীক্ষিতই থেকে গেছে।

প্রেসিডেন্ট শি বলেছেন, তিনি যথাযথ সময়ে নেপাল সফর করবেন। এটি এই বার্তা পাঠিয়েছে যে নেপাল এখন চীনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নজরদারিতে রয়েছে এবং আগামীতে বিশেষ করে কৌশলগত বিষয়াদিতে আরো গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে।

নেপাল ইতোমধ্যেই প্রেসিডেন্ট শি’র ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগে সই করেছে। তবে তাকে নিশ্চিত করতে হবে যে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে দেশটি যাতে ঋণের ফাঁদে পড়ে না যায়। নেপালের জন্য এটি নিশ্চিতভাবেই চ্যালেঞ্জের হবে।

একইসাথে গত ১১ বছরে নেপাল ১১টি সরকার দেখেছে। চীনের সাথে সাবলীলভাবে কাজ করতে হলে তার কয়েক বছরের জন্য হলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সত্যিই প্রয়োজন।

মজার ব্যাপার হলো, চীন হয়তো আলাদাভাবে বেইজিং সফরের জন্য প্রচন্ডকে আমন্ত্রণ জানাতে পারে। দুই কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্যের প্রতি তার নিষ্ঠতা ও দৃঢ়তার জন্য এটি দরকার। এটি নেপালের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads