• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
লাশের মিছিলে রুদ্ধ বিবেক

শ্রীলঙ্কায় নিহত ২৯০

সংগৃহীত ছবি

এশিয়া

শ্রীলঙ্কা ট্র্যাজেডি

লাশের মিছিলে রুদ্ধ বিবেক

নিহত ২৯০

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২৩ এপ্রিল ২০১৯

দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কায় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের রোববারের সকালটি শুরু হয়েছিল উৎসবমুখর পরিবেশে। খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীদের  জন্য খুবই আনন্দের ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন ‘ইস্টার সানডে’। সে উপলক্ষে গির্জায় সমাগম ঘটেছিল বহু মানুষের। অথচ পবিত্র এই দিনটি রক্তাক্ত হলো সহিংসতার হিংস্র থাবায়। দেশটির চারটি গির্জা ও চারটি হোটেলে বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন বিভিন্ন দেশের নাগরিকসহ ২৯০ জন। এই ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন আরো কয়েকশ’ মানুষ। দিন কয়েক আগে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদের নারকীয় হামলার ঘটনার পর ফের উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।

প্রথম দিকে এই হামলার দায় কেউ স্বীকার না করলেও সোমবার বিকালের দিকে  হামলার দায় স্বীকার করেছে স্থানীয় ইসলামী চরমপন্থি গোষ্ঠী ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত (এনটিজে)। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকেও সংগঠনটির জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। সোমবার কলম্বোর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সন্দেহভাজন হিসেবে মোট ২৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরাই অধিকাংশ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলে তদন্তকারীদের ধারণা।

এদিকে হামলার পর আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হওয়া কলম্বোতে রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে দেশটির সরকার। পাশাপাশি সোম ও মঙ্গলবার ঘোষণা করা হয়েছে সরকারি ছুটি। জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। পাশাপাশি গুজব ঠেকাতে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যমগুলোও সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।

হামলার ঘটনার পর নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমসিংহে বলেছেন, আমি এই কাপুরুষোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। দেশের মানুষকে আমি ঐক্যবদ্ধ ও শক্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।

ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস এ হামলাকে ‘অত্যন্ত নিষ্ঠুর সহিংসতা’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রতি ‘হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসা’ প্রকাশ করেছেন তিনি।

যেভাবে হামলা

বিবিসি জানিয়েছে, তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে বিস্ফোরণের খবরটি আসে স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ৯টার দিকে। ‘যিশুর পুনরুত্থান’ দিবস উদযাপনে গির্জাগুলোতে তখন চলছিল বিশেষ প্রার্থনা। এর মধ্যে ১৯ শতকের শুরুতে নির্মিত কোচিকাডের সেইন্ট অ্যান্থনির গির্জা শ্রীলঙ্কার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। খ্রিস্টানদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছেও এটি একটি আকর্ষণীয় জায়গা। এছাড়া কাটুয়াপিতিয়ার সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ এবং বাত্তিকালোয়ার জিয়ন গির্জাও শ্রীলঙ্কায় ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাসনালয়।

বিস্ফোরণে প্রতিটি গির্জাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ছাদ উড়ে যায়। বিধ্বস্ত গির্জাগুলোর বেঞ্চ আর যিশুর ভাস্কর্যে রক্তের দাগ লেগে থাকতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা ছবি ও ভিডিওতে। এক প্রত্যক্ষদর্শী বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর দৌড়ে সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চে গিয়ে মেঝেতে লাশ পড়ে থাকতে দেখার কথা বলেছেন বিবিসিকে। কামাল নামের ওই ব্যক্তি বলেন, পৌনে ৯টার দিকে বিকট ওই বিস্ফোরণের শব্দ পান তিনি। এরপর লোকজন দৌড়ে বের হয়ে আসতে দেখেন। তারা চিৎকার করে অনেক লোকের মৃত্যুর কথা বলছিল।

তিনি বলেন, আমরা দৌড়ে গির্জার ভিতরে গিয়ে লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। আমরা প্লাস্টিক দিয়ে সেগুলো ঢেকে দিলাম। এরপর পুলিশ এসে সবাইকে সেখান থেকে বের করে দিল। ইস্টার সানডের প্রার্থনার জন্য ওই গির্জায় পাঁচ শতাধিক লোক জড়ো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।

প্রায় একই সময়ে বিস্ফোরণ হয় কলম্বোর শাংরি লা, সিনামন গ্র্যান্ড ও কিংসবুরি হোটেলে। প্রতিটি হোটেলের রেস্তোরাঁয় তখন সকালের নাশতা সারতে আসা পর্যটকদের ভিড় ছিল। আর সেই পর্যটকরাই ছিল আত্মঘাতী হামলাকারীদের টার্গেট।

শ্রীলঙ্কায় বেড়ে ওঠা ৪৮ বছরের চিকিৎসক জুলিয়ান ইমানুয়েল পরিবার নিয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যে। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে কলম্বো এসে তারা উঠেছিলেন সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে।

বিবিসিকে ইমানুয়েল বলেন, বিকট বিস্ফোরণের সময় আমরা হোটেলের ঘরেই ছিলাম। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আমাদের ঘর কেঁপে উঠল। পরে আমাদের হোটেলের লাউঞ্জে নিয়ে আসা হলো, পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে বলা হলো। সেখানে আমরা কয়েকজন হতাহতকে দেখতে পেলাম, তাদের তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

সকালের নাশতা খেতে যেতে তার সামান্য দেরি হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান লন্ডন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক কিরণ আরাসারত্নম। তিনি বলেন, এত জোরে শব্দ হয়েছিল যে আমি বজ্রপাত ভেবেছিলাম। সবাই আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু করে। বেশিভাগ মানুষ বুঝতে পারেনি আসলে কী হয়েছে। লোকজনের শার্টে রক্ত লেগে ছিল, ছোট একটা মেয়েকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছিল দেয়াল, মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।

একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে করে হতাহতদের নেওয়া হচ্ছিল হাসপাতালে। স্বেচ্ছাসেবীদের আহ্বানে বহুন মানুষ ততক্ষণে রক্ত দিতে ভিড় করেছেন ব্লাড ব্যাংকে।

কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর দেহিওয়ালায় চিড়িয়াখানার কাছে ট্রপিকাল ইন হোটেলে সপ্তম এবং দেমাটাগোদা এলাকায় একটি বাড়িতে পুলিশি অভিযানের সময় অষ্টম বিস্ফোরণের খবর আসে। দেমাটাগোদা এলাকায় বিস্ফোরণে তিন পুলিশ সদস্য নিহত হন।

গত বছর একটি বৌদ্ধমূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শ্রীলঙ্কার উগ্রপন্থি মুসলিমদের সংগঠন ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াতের নাম খবরে এসেছিল। কিন্তু পুলিশ প্রধানের ওই সতর্কবার্তা পুরোপুরি আমলে না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, আমাদের এ বিষয়গুলো আরও খতিয়ে দেখতে হবে। দেশকে অস্থিতিশীল করার মতো সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হয়নি।

বিবিসি সিনহলার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন এ ঘটনার পেছনে ছিল বলে প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন।

স্বাধীন দেশের জন্য ২৬ বছর লড়াই করার পর তামিল টাইগারদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালে শেষ হয় শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে শ্রীলঙ্কায় বিচ্ছিন্ন কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সিংহল সম্প্রদায়ের আক্রমণের শিকার হয়েছে মসজিদ। এর জের ধরে ২০১৮ সালের মার্চে দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার ৭০ দশমিক ২ শতাংশ বৌদ্ধ, ১২ দশমিক ৬ শতাংশ হিন্দু, ৯ দশমিক ৭ শতাংশ মুসলিম ও ৭ দশমিক ৪ শতাংশ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads