• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

এশিয়া

গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ চলছে মিয়ানমারে

সামরিক বাহিনীর ধরপাকড় অব্যাহত

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

জান্তা সরকারের হুঁশিয়ারি, নানা নিয়মকানুন জারি, গ্রেপ্তার, জেল-জরিমানা কোনো কিছুই সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জনগণের বিক্ষোভ-সমাবেশকে দমাতে পারছে না বরং দিনকে দিন গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ জোরালো হচ্ছে। এদিকে মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আসিয়ানে আলোচনা করতে সম্মত হয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনাই। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে একথা জানান। খবর বিবিসি, সিএনএন, আনাদোলু এজেন্সি ও আলজাজিরার।

গতকাল বৃহস্পতিবার ইয়াঙ্গুনের শহরতলির ব্যস্ত সংযোগ সড়ক থেকে শুরু থেকে পুরোনো রাজধানী বাগান সবখানে সব শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ সেনাশাসনের প্রতিবাদ জানিয়েছে। টানা ১৩ দিন ধরে তারা সেনাশাসনের অবসান ও নির্বাচিত নেতা অং সান সু চিসহ কয়েকশ নেতাকর্মীর মুক্তির দাবি করে আসছেন।  প্রতিদিনকার এই বিক্ষোভ ও ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়ছে বহু সরকারি দপ্তর। সেনাশাসকদের হুমকি সত্ত্বেও বিক্ষোভ প্রশমিত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তবে সামরিক সরকারের দমনপীড়নের তুলনায় বিক্ষোভকারীরা বেশ শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে আন্দোলন করছেন। বিভিন্ন পেশার কর্মীদের কাজে ইস্তফার ফলে অফিসিয়াল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের কয়েক দিন পর থেকেই জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে দেশটির শিক্ষক, শ্রমিক, চিকিৎসক, সরকারি কর্মকর্তাসহ সর্বস্তরের জনতা বিক্ষোভ করে আসছেন। সেইসঙ্গে সামরিক সরকারের দ্বারা চলছে গ্রেপ্তারও। অভ্যুত্থানের পর থেকে গত বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৫শ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিক্ষোভে মদত দেওয়ার অভিযোগে দেশটির ছয়জন সেলিব্রেটির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে জান্তা সরকার। এই ছয় জন দেশটির জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী। এসব অভিযোগের কারণে তাদের দুই বছর কারাদণ্ড হতে পারে।

গতকাল বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের কেন্দ্রস্থলে সুলে প্যাগোডার সামনে সমবেত হয় বিপুলসংখ্যক মানুষ। এ ছাড়া প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের একটি সড়ক সংযোগেও বড় জমায়েত দেখা যায়। মূলত শান্তিপূর্ণ এই বিক্ষোভ ও নাগরিক অসহযোগ আন্দোলনের কারণে আক্রান্ত হচ্ছে বেশিরভাগ সরকারি বাণিজ্য। সেনাশাসনের প্রতিবাদ জানাতে ইয়াঙ্গুনের বহু গাড়িচালক খুব ধীরগতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। এভাবে প্রতিবাদ করা কো সোয়ে মিন বলেন, আমি স্বৈরশাসনের মধ্যে জেগে উঠতে চাই না। বাকি জীবন আমরা ভয়ের মধ্যে পার করে দেব না। সরকারি কর্মকর্তারা দেরি করে কাজে গেলে কিংবা একেবারেই না গেলেই আমি খুশি হব।

দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয় এবং পুরোনো রাজধানী বাগানেও রং-বেরঙের ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ করে সেনাশাসনের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। নাগরিক অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে দেশটির সামরিক সরকার। কিন্তু তাদের কোনো পন্থায় জনগণকে দমাতে পারছে না। প্রতিবাদকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কোথাও কোথাও পুলিশকে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছে। রাজধানী নেপিডোতে গতকালও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারীদের সরাতে জলকামান ব্যবহার করেছে। উত্তরের একটি শহরে ব্যবহূত হয়েছে ক্যাটাপুল্ট।  বুধবার রাতে মান্দালয়ে আইন অমান্য করে আন্দোলনে অংশ নেওয়া রেলওয়ে কর্মীদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছুড়েছে। রেলওয়ের কর্মীরা কয়েকটি ট্রেন আটকে দিলে পুলিশ বাধা দেয়। এই নিয়ে দুপক্ষের মুখোমুখি অবস্থানে এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি করে। এতে একজন আহত হন। 

মিয়ানমার এর আগেও প্রায় অর্ধশতক সেনা শাসনে ছিল। সে সময়কার বিক্ষোভগুলোতে নিয়মিত রক্তপাতের ঘটনা ঘটলেও এবার তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। তবে প্রতিবাদকারীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি এবং আইন অমান্যের ডাক ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা নেওয়া সামরিক জান্তাকে বেশ বিপাকেই ফেলেছে। বৃহস্পতিবার ইয়াঙ্গুনে অনেক চালককেই শম্বুকগতিতে গাড়ি চালাতে দেখা গেছে। আগের দিন চালকরা বিভিন্ন সড়ক ও সেতুতে গাড়ি ফেলে রেখে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যান চলাচলে বাধার সৃষ্টি করেছিল। সুত সেং হাতোই নামের এক বিক্ষোভকারী বলেন, তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বা সংবিধান অনুযায়ী কাজ করছে না। তারা সন্ত্রাসীদের মতো আচরণ করছে। বিক্ষোভ দমনে শক্তি প্রয়োগ প্রসঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তিনজনকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন মিয়ানমারের আদালত। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন একজন আঞ্চলিক পরিবেশমন্ত্রী। তাকে মান্দালয় শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চারজন ট্রেন অপারেটরসহ ছয় জনকে বন্দুকের মুখে সেনাবাহিনী তুলে নিয়েছে বলে জানা গেছে। রাখাইন রাজ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ধর্মঘটের ডাক দেওয়ায় আটজন সরকারি কর্মচারীকে বুধবার বিচারের সম্মুখীন করা হয়। মিয়ানমারের অভিনেতা লু মিন ফেসবুকে বলেন, দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। জনগণের ক্ষমতা তাদের হাতেই ফিরিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া দ্য ডিফেন্ড ল’ইয়ার্সের ওয়েবসাইটে বলা হয়, সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় কমপক্ষে ৪০ জন ব্যারিস্টারের নামে মামলা হতে পারে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে মিয়ানমারের অনেক আইনজীবী রেড রিবন ক্যাম্পেইনে যোগ দিয়েছেন।

এদিকে সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আসিয়ানে আলোচনা করতে সম্মত হয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও ব্রুনাই। ব্রনাইয়ের রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ানে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে এই সম্মতি আসে বলে গত বুধবার ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানায়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান। এই জোটের অন্যতম সদস্য মিয়ানমার। ব্রুনাই বর্তমানে জোটটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছে। ব্রুনাই সফরের অংশ হিসেবে বুধবার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরিওয়ান ইউসুফের সঙ্গে বৈঠক করেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি। বৈঠকে রেতনো জোর দিয়ে বলেন সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সংকট নিরসন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে আসিয়ান। এজন্য আসিয়ান সদস্যসহ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। জোর দিয়ে বলেন মিয়ানমার সংকটের সমাধান খুঁজে পেতে হস্তক্ষেপ মুক্ত, গঠনমূলক সম্পৃক্ততাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং জনগণের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নীতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো প্রয়োজন। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফেরাতে সব অংশীদারকে সহায়তা করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

উল্লেখ্য, এ মাসের শুরুতে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটিতে নতুন নির্বাচন আয়োজনে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা উপেক্ষা করে রাস্তায় নামছে মানুষ। বিক্ষোভকারীরা সামরিক জান্তার আশ্বাসের ব্যাপারে ব্যাপক সন্দিহান। দেশটির সামরিক বাহিনীর ভাষ্য, গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতে জনগণের সমর্থন আছে। তবে সেই ভাষ্যকে মিথ্যে প্রমাণ করে গতকালও বড় ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেয় হাজার হাজার মানুষ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads