• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

ব্যাংক

খেলাপি ঋণ সংস্কৃতিতে চট্টগ্রাম

  • প্রকাশিত ২১ জানুয়ারি ২০১৮

 

ব্যাংকগুলোর বড় অংকের ঋণ আছে চট্টগ্রামের বনেদি ব্যবসায়ীদের কাছে। ইচ্ছামতো ঋণ পেয়েছেন অনভিজ্ঞ ও উঠতি ব্যবসায়ীরাও। নিরাশ হতে হয়নি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকেও। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ীদের কাছেই ব্যাংকঋণ আছে দেড় লাখ কোটি টাকার মতো। ঋণের অর্থের কতটুকু ফেরত আসবে, সে ব্যাপারে ধারণা নেই ব্যাংকগুলোর। ব্যাংকগুলো এ নিয়ে উদ্বেগে থাকলেও নিরুদ্বেগ ঋণগ্রহীতারা। ব্যাংকের অর্থ বকেয়া রেখে অনেকেই বিদেশে আয়েশি জীবনযাপন করছেন। ব্যাংক কর্মকর্তারা ধরনা দিলেও কেউ কেউ আবার তাদের পাত্তাই দিচ্ছেন না।

 

বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন ক্লিউসটন গ্রুপের কর্ণধার এমএ আলীম চৌধুরী। ভোগ্যপণ্য আমদানি, শিপ ইয়ার্ড, প্লাস্টিক রিসাইক্লিং, এগ্রো, বেভারেজ ব্যবসার নামে ঋণ নিলেও এর বড় অংশই বিনিয়োগ করেছেন জমি ক্রয়ে। পরিশোধ না করায় পুরো ঋণই এখন খেলাপি। পাওনা আদায়ে ব্যাংকগুলোকে ছুটতে হচ্ছে এ ব্যবসায়ীর পেছনে। যদিও নাগাল মিলছে না তার। বাধ্য হয়ে মামলার পথে হাঁটছে এ ব্যবসায়ীকে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলো।

 

জানা গেছে, এমএ আলীম চৌধুরীর কাছে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার পাওনা রয়েছে ৫৩ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়ার আন্দরকিল্লা শাখার ৩৬ কোটি ও প্রাইম ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া ব্র্যাক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার প্রায় ৪০ কোটি, সোনালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ২৫ কোটি, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া আগ্রাবাদ শাখার ১৮ কোটি, হাবিব ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১৭ কোটি টাকাও পরিশোধ করছেন না তিনি।

 

ব্যাংক এশিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব ব্রাঞ্চ (আন্দরকিল্লা শাখা) মো. শামসুল আলম বলেন, ২০০৮-০৯ সালের দিকে ভোগ্যপণ্য আমদানির নামে এ ঋণ নেন গ্রাহক। দীর্ঘ এক যুগেও ঋণের টাকা ফেরত দেননি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা গুটিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন তিনি। বহু চেষ্টার পরও ঋণের টাকা ফেরত না পাওয়ায় ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে মামলা করতে হয়েছে।

 

সোনালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ২০০৭-০৮ সালের মধ্যে স্ক্র্যাপ আমদানির নামে ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেয় ক্লিউসটন গ্রুপ। কিন্তু স্ক্র্যাপ ব্যবসা না করে ভিন্ন খাতে তা সরানো হয়। এক যুগেও সে টাকা আর ফেরত দেননি গ্রাহক।

 

সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঋণের টাকা উদ্ধারে ক্লিউসটন গ্রুপের আগ্রাবাদের কার্যালয়ে বারবার যোগাযোগের পরও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। এমনকি ব্যাংক কর্মকর্তাদের কোনো পাত্তাই দেন না প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী এমএ আলীম চৌধুরী। ব্যাংকের টাকা পরিশোধের কোনো মানসিকতাই তার মধ্যে নেই।

 

শিপ ব্রেকিং খাতের উড়ন্ত সময়ে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের মাধ্যমে মাবিয়া গ্রুপ গড়ে তোলেন জাহাঙ্গীর আলম ও ফরিদুল আলম। গ্রুপটিকে বড় অংকের ঋণ দেয় বেসরকারি দ্য সিটি ও এবি ব্যাংক। ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ায় মাবিয়া গ্রুপের এ ঋণ আদায়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গ্রুপটির কাছে ব্যাংক দুটির আটকে গেছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

 

দেশের এক ডজন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন ক্রিস্টাল গ্রুপের কর্ণধার মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম ও তার পরিবার। ঋণের অর্থ খেলাপি হয়ে গেছে অনেক আগেই। টাকা আদায়ে এখন মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম ও তার ভাইদের পেছনে ঘুরতে হচ্ছে ব্যাংকারদের।

 

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের বিপুল অংকের ঋণ বকেয়া রেখে দেশ ছেড়েছেন চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ায় সপরিবারে বিলাসী জীবনযাপন করছেন তারা। চট্টগ্রামভিত্তিক ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী তিন ভাই জয়নাল আবেদিন, জামিল আবেদিন ও মোহাম্মদ আলাউদ্দিনও আছেন এদের মধ্যে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ২০০৭ সালে শিপ ব্রেবিং ব্যবসা শুরু করেছিলেন তারা। এরপর ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করেই বিদেশে পাড়ি জমান জয়নাল আবেদিন ও জামিল আবেদিন। ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের কাছে ১২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা দাঁড়িয়েছে বর্তমানে ৮০০ কোটি টাকার বেশি।

 

ভোগ্যপণ্য আমদানিতে দ্রুত প্রসার ঘটে খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইয়াছির এন্টারপ্রাইজের। ২০০৯ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানটি বড় পরিসরে ভোগ্যপণ্য আমদানি শুরু করে। ২০১২-১৩ সালে ভোগ্যপণ্য আমদানি করে বড় ধরনের লোকসানে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে ব্যাংকের দায় না মিটিয়েই ২০১৪ সালের শুরুর দিকে সপরিবারে কানাডা পাড়ি দেন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ মোজাহের হোসেন। ইয়াছির গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ ও শাপলা ফ্লাওয়ার মিলসে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় হাজার কোটি টাকা বকেয়া রেখেই বিদেশ পাড়ি দেন এ ব্যবসায়ী।

 

২০০৯-১০ সালের দিকে ইস্পাত, শিপ ব্রেকিং ও আবাসন ব্যবসার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন মিশম্যাক গ্রুপের কর্ণধার তিন ভাই হুমায়ুন কবির, মিজানুর রহমান শাহীন ও মুজিবুর রহমান মিলন। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেন তারা। ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ২০১২ সালের পর প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের শুরু করে ব্যাংকগুলো। ঠিক ওই সময় সপরিবারে বিদেশ চলে যান তিন ভাই।

 

ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী বিনিয়োগের কারণেই এ অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বাছবিচার না করে ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকগুলো নানা খাতে বিনিয়োগ করেছে। ভালো ব্যবসায়ীর পাশাপাশি মন্দ লোকেরাও ব্যাংক থেকে রাতারাতি ঋণ পেয়েছে। এর ফলে বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ভালো ব্যবসায়ীরা। আর প্রতারকরা ব্যাংকের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলার ব্যাংক শাখাগুলোয় জমা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকার আমানত। একই সময়ে ব্যাংকগুলো জেলাটিতে ঋণ বিতরণ করেছে ১ লাখ ১৫ হাজার ২৩১ কোটি টাকার। ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বিভিন্ন ব্যাংক শাখা থেকেও বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। এটা যোগ করলে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ীদের ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকার কম হবে না।

 

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছে বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ এসব গ্রাহকের মধ্যে চট্টগ্রামের পুরনো প্রতিষ্ঠান যেমন আছে, একই সঙ্গে রয়েছে খাতুনগঞ্জের ‘চিনি বশর’, বাকলিয়ার ‘গাছ কামাল’, ময়দার ব্যাপারী আবু সৈয়দ, মাবিয়া গ্রুপ, নূর-উন-নবীর মতো অখ্যাত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানও। অখ্যাত এসব ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানই বেশি ভাবাচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।

 

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের আগ্রাসী ঋণ প্রদান ও খেলাপি হয়ে যাওয়ার বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে বলে মন্তব্য করেন রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের বিপর্যয় হয়েছে জাহাজ ভাঙা শিল্পে। উন্নত বিশ্ব থেকে আমাদের দেশে শিল্পটি স্থানান্তর হওয়ার পর ব্যবসা বোঝেন, এমন অনেকে বিনিয়োগ করেছেন। আবার চাল-ডাল ও তেল ব্যবসায়ীরাও এ খাতে বিনিয়োগ করে রাতারাতি ধনী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। ব্যাংকও বুঝে না বুঝে খাতটিতে আগ্রাসী বিনিয়োগ করেছে। ফলে ঋণ হিসেবে নেয়া অনেক টাকাই যথাযথ খাতে বিনিয়োগ না হয়ে অন্য খাতে চলে গেছে। ঋণের টাকা দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে বলেও আমরা শুনতে পাচ্ছি।

সূত্রঃ বণিক বার্তা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads