• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
ব্যাংক এমডিরাই বলির পাঁঠা!

কেন্দ্রীয় ব্যাংক

সংরক্ষিত ছবি

ব্যাংক

ব্যাংক এমডিরাই বলির পাঁঠা!

দুই বছরে বিদায় নিতে হয়েছে আটজনকে

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ০৫ নভেম্বর ২০১৮

ব্যাংক চালাতে গিয়ে বলির পাঁঠা হচ্ছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি)। গত দুই বছরে অন্তত আট এমডিকে দায়দায়িত্ব মাথায় নিয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন মালিকদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়। আর দুজনকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপসারণ করেছে মালিকদের দুর্নীতি গোপন করায়। অথচ পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া এমডিরা এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। পারেন না কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি করতেও। কিন্তু সেই পর্ষদ সদস্যরা সবসময় থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা আর সাহস করে পর্ষদের বিপক্ষে মুখ খুলছেন না। কোনোভাবে চুক্তির সময় পার করছেন তারা। কোনো কোনো এমডি আবার পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে সায় দিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর ধান্ধায় থাকেন, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য অশুভ সঙ্কেত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, ব্যাংকে এমডি পদ সর্বোচ্চ। তাকে কাজ করার স্বাধীনতা দিতে হবে। নির্ভয়ে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন অধরাই থেকে যাবে। তাদের মতে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমনিতেই দক্ষ ও পেশাদার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ঘাটতি রয়েছে। দীর্ঘদিন চাকরি করে শীর্ষ পদে এলেও আধুনিক অর্থনীতি, ব্যাংকিং ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অনেকের ধারণা পর্যাপ্ত নয়। তার ওপর যদি ভয়ে ভয়ে তাদের কাজ করতে হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।

কোনো তফসিলি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নিযুক্তি ও দায়দায়িত্ব সম্পর্কিত বিধিবিধান উল্লেখ করে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নির্দেশনা জারি করে। এরপর ২০১৪ সালে তাতে কিছু সংশোধন এনে পুনরায় নির্দেশনাটি জারি করা হয়।

এতে বলা হয়, প্রধান নির্বাহী নিযুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং ঐরূপে নিযুক্ত প্রধান নির্বাহীকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ব্যতীত তার পদ হতে বরখাস্ত, অব্যাহতি প্রদান বা অপসারণ করা যাবে না। তবে নিয়োগ চুক্তির মেয়াদপূর্তির পূর্বে প্রধান নির্বাহী চুক্তি বাতিল করতে চাইলে বা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে চাইলে তার প্রকৃত কারণ উল্লেখপূর্বক কমপক্ষে এক মাস আগে এ সংক্রান্ত নোটিস ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানকে দিতে হবে। একই সময়ে ওই নোটিসের অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হবে।

একইভাবে নিয়োগ চুক্তির মেয়াদপূর্তির আগে পরিচালনা পর্ষদ চুক্তি বাতিল করতে চাইলে বা প্রধান নির্বাহীকে পদত্যাগের নির্দেশ প্রদান করলে তার কারণ উল্লেখপূর্বক তাকে কমপক্ষে এক মাসের নোটিশ দিতে হবে এবং একই সময়ে ওই নোটিশের অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া নিয়োগ চুক্তি বাতিল কিংবা প্রধান নির্বাহীকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না। কিন্তু উল্লিখিত কোনো ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ব অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

গত বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকে হঠাৎ বড় পরিবর্তন ঘটে। চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্পগোষ্ঠী এর মালিকানায় আসে। এরপর রাজধানীর একটি তারকা হোটেলে প্রথম পর্ষদ সভায় পদত্যাগ করতে হয় তৎকালীন এমডি আবদুল মান্নানকে। তিনি দীর্ঘদিন ব্যাংকটির এই শীর্ষ পদে থাকলেও তাকে বিদায় নিতে হয় অপমানজনকভাবে।

এরপর ওই গ্রুপটি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় এসে একই কায়দায় বিদায় করে এমডি সহিদ হোসেনকে। নতুন প্রজন্মের মেঘনা ব্যাংকের এমডি ছিলেন মোহাম্মদ নূরুল আমিন। তিনি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ-এবিবির দুই দফা চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু মেঘনা ব্যাংক থেকে তাকে পদত্যাগ করতে হয় মূলত পর্ষদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়। 

চলতি বছরের আগস্টে দুজন এমডিকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। যাদের একজন হলেন বেসিক ব্যাংকের মুহাম্মদ আউয়াল খান, অন্যজন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের এ ই আবদুল মুহাইমেন। দুজনই পর্ষদের সঙ্গে না মানাতে পেরে সরে গেছেন। আর সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিদায় নিয়েছেন এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান চৌধুরী। অভ্যন্তরীণ ও বাইরের চাপে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন এই ব্যাংকার।

অবশ্য পর্ষদের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে সায় দিয়ে চাকরি হারিয়েছেন নতুন প্রজন্মের দুটি ব্যাংকের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা। তারা হলেন, এনআরবিসি ব্যাংকের দেওয়ান মুজিবুর রহমান ও ফারমার্স ব্যাংকের একেএম শামীম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোম্পানি আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে তাদের অপসারণ করে। অবশ্য এই দুই ব্যাংকার বাংলাদেশ ব্যাংকের শুনানিতে এসে জানান, পর্ষদের কারণে স্বাধীনভাবে তারা কাজ করতে পারেননি। তবে এই দুই ব্যাংকের পর্ষদ পরিচালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কয়েকজন সরে গেছেন নিজ উদ্যোগে।

বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংকের এমডি আহমেদ কামাল খান চৌধুরী ও এনসিসি ব্যাংকের গোলাম হাফিজ আহমেদকে পুনরায় নিয়োগ দেয়নি ব্যাংকগুলোর পর্ষদ। এর মূলে রয়েছে বিরোধ। 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে রীতিমতো বিশৃঙ্খলা চলছে। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে ভূমিকা দরকার সেটি নেই। পুরো খাত একটি খারাপ সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। সেটা ব্যাংকের মালিকানা থেকে গ্রাহক পর্যন্ত। ফলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। আবার অনেক সময় ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন, তারাও পর্ষদের সঙ্গে মিলেমিশে দুর্নীতি করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। যখনই এর কোনো ব্যত্যয় নজরে আসছে আমরা সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিচ্ছি। যে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা কার্যকরভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করছে।

এবিবির চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, এমডিরা যত স্বাধীন ও নির্ভয়ে কাজ করতে পারবেন ততই ব্যাংকের মঙ্গল।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads