• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
দশ বছরে ব্যাংক থেকে লুট ২২ হাজার ৫০২ কোটি

বাংলাদেশ ব্যাংক লোগো

ব্যাংক

দশ বছরে ব্যাংক থেকে লুট ২২ হাজার ৫০২ কোটি

সিপিডির সংলাপ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮

প্রতারণার মাধ্যমে ১০ বছরে ব্যাংক থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ ছাড়িয়েছে লাখো কোটি টাকা। সরকারি ব্যাংকের ২৮ শতাংশের বেশি ঋণখেলাপি। মালিক, পরিচালক ও অসৎ ব্যাংকারদের যোগসাজশে জনগণের আমানত বেহাত হচ্ছে। মূলধন সঙ্কটে থাকা ব্যাংকে বছরের পর বছর অর্থায়ন করছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, আইনের প্রয়োগের অভাব ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে ব্যাংক খাতে দুরবস্থা বাড়ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক সংলাপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের এমন ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে কী করিব?’ শীর্ষক সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। ব্যক্তি উদ্যোক্তা ও বিভিন্ন ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন।

ব্যাংক খাতের সুরক্ষায় নির্বাচনের পর সিপিডি একটি ‘নাগরিক কমিশন’ গঠন করবে বলে সংলাপে জানান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এ কমিশন ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরবে। ব্যাংক খাত নিয়ে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করা হবে। সমাধানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনসহ বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হবে।

তিনি আরো বলেন, ব্যাংক খাত সবচেয়ে খারাপ সময় অতিক্রম করছে। এ খাত রক্ষায় নাগরিকদের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচনের আগে সোচ্চার হওয়ার প্রধান সময়। নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যাংক রক্ষার ঘোষণা থাকতে হবে। ব্যাংকের উন্নয়নে তারা কী ভূমিকা পালন করবেন তার ঘোষণাও থাকতে হবে।

ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, গ্রাহকের আস্থা উঠে যাওয়ায় এখন অনেকেই নিরাপদ ব্যাংকের খোঁজ করেন। আগে কখনো ব্যাংক খাতে আস্থার এত অভাব ছিল না। তিনি আরো বলেন, এক সময় ঋণখেলাপি ও অপরাধী ব্যাংক মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন নিয়ম শিথিল করা হচ্ছে। ভোটের আগে প্রভাবশালী ঋণখেলাপিরা সুবিধা নিয়েছেন।

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের পর্ষদে রাজনীতি ঢুকেছে। ব্যাংক খাত রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। রাজনৈতিকভাবে বিকৃত প্রণোদনা বাতিল করতে হবে। ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের পেছনে ছুটছে আর ছোটরা ঋণের জন্য ব্যাংকে ব্যাংকে দৌড়াচ্ছে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকের মূলধনে পরিচালকদের মালিকানা ৯ শতাংশের মতো। আর ৯০ শতাংশের বেশি অর্থের মালিক আমানতকারীরা। পরিচালকদের পক্ষে পর্ষদে কথা বলার লোক থাকলেও মূল মালিকদের প্রতিনিধি নেই। ফলে পরিচালকরা লুটপাটের সুযোগ পাচ্ছেন।

সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ মূলধনের বিপরীতে অর্থ সংরক্ষণ, খেলাপি ঋণ ও তারল্য ব্যবস্থাপনা সূচকে ব্যাংকগুলোর অবনতি হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ গত ১০ বছরে রেকর্ড ছাড়িয়ে ২৮ দশমিক ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। খেলাপি ঋণের ৪৭ শতাংশ পুঞ্জীভূত পাঁচটি ব্যাংকে। সরকারি ব্যাংক থেকে অনিয়মের প্রবণতা সংক্রামক ব্যাধির মতো বেসরকারি ব্যাংককেও গ্রাস করেছে। ইতোমধ্যেই দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ে ডুবতে থাকা ফারমার্স ব্যাংকে সরকারের চার ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৭৬৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেওয়া হয়েছে।

প্রবন্ধে আরো বলা হয়, গত ১০ বছরে ১৪ ব্যাংক থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। অনিয়মে মূলধন হারানো সরকারি ব্যাংকগুলোকে ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার।

ব্যাংক ব্যবস্থার সুরক্ষায় অর্থঋণ আদালত ও দেউলিয়া আইনের দ্রুত প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তা ছাড়া আমানতের সুরক্ষা নিশ্চিত করে দুর্বল ব্যাংকের ব্যবসা থেকে বের হয়ে আসার নীতিমালা তৈরি, ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারের তহবিল থেকে বছরের পর বছর অর্থায়ন বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বড় গ্রাহকদের হাতে ব্যাংকের ঋণ ও মালিকানা কেন্দ্রীভূত। সুশাসনের অভাবে আমানতকারীদের স্বার্থ ঝুঁকিতে পড়ছে। ব্যাংক খাত রক্ষায় অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ বাতিল করতে হবে। খেলাপি গ্রাহকদের সীমাহীন সুবিধা দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল বলেন, ঋণখেলাপি ও ব্যাংক লুটকারীদের নির্বাচনে মনোনয়ন না দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ফারমার্স ব্যাংকের এমডি এহসান খসরু বলেন, রাজনৈতিকভাবে এক চরম প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তার আশপাশের মানুষ ফারমার্স ব্যাংককে শেষ করেছে। চাকরি যাওয়ার ভয় এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় অসৎ পরিচালকদের সঙ্গে ব্যাংকাররা হাত মেলাতে বাধ্য হচ্ছেন।

সংলাপে অন্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ, ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী আলী রেজা ইফতেখার, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী, মেঘনা ব্যাংকের সাবেক এমডি নুরুল আমিন প্রমুখ বক্তব্য দেন।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads