• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বেসরকারি ঋণে লাগাম

কমে যাবে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড

ছবি : সংগৃহীত

ব্যাংক

বেসরকারি ঋণে লাগাম

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩১ জানুয়ারি ২০১৯

বেসরকারি ঋণের লাগাম টেনে ধরা হবে আগামী ছয় মাসে। তবে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ঋণের জোগান বাড়বে। আর মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে সতর্ক থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, উৎপাদন কর্মকাণ্ডে কোনো বিঘ্ন ব্যতিরেকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর অর্থবর্ষের দ্বিতীয়ার্ধে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকাণ্ডের ধারা আরো জোরালো হবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।  

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। যা অর্থবছরের প্রথমার্ধের ঘোষিত মুদ্রানীতি থেকে দশমিক ৩ শতাংশ কম। আগের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ ধরা হয় ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে ডিসেম্বর শেষে ঋণের প্রকৃত হারের থেকে প্রাক্কলন হার প্রায় ৩ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন মুদ্রানীতি নতুন সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলেছে, নতুন সরকারের শেষ মেয়াদে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ২ হাজার ৭৫০ ডলার। বাজেটের আকার দাঁড়াবে ১০ লাখ কোটি টাকা, যা সর্বশেষ বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলার করবে এই সরকার। আর জিডিপির ৩৭ শতাংশ হবে বিনিয়োগ হার। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিনিয়োগ তথা অর্থনীতিকে আরো গতিশীল করতে হবে। বেসরকারি খাতকে অর্থনীতির চালকের আসনে বসাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও সরকারের অর্থনৈতিক লক্ষ্য সম্পর্কে সতর্ক। তবে মুদ্রানীতিতে তার প্রতিফলন আসেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ফজলে কবির মুদ্রানীতি তুলে ধরেন। মুদ্রানীতিতে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রা ও আর্থিক নীতি কার্যক্রমের সামগ্রিক সফলতা পাওয়া গেছে। তাই নতুন মুদ্রানীতি প্রোগ্রামে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের দ্বিতীয়ার্ধে বড় কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন অনুভূত হয়নি। রেপো ও রিভার্স রেপো সুদ হার ৬ দশমিক এবং ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশে অপরিবর্তিত থাকবে। ব্যাপক মুদ্রা এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ১২ শতাংশ এবং ১৫ দশমিক ৯ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে, অর্থবছরের প্রথমার্ধের প্রকৃত গতিধারা বিবেচনায় নিয়ে নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের মুদ্রানীতিতে ছিল ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আগেকার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কিছুটা সংশোধন করে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। এ ছাড়া, অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে প্রত্যাশিত জোরালোতর বিনিয়োগ কর্মকাণ্ডের সূত্রে আমদানির সম্ভাব্য বৃদ্ধির কারণে নিট বৈদেশিক সম্পদের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি প্রথমার্ধের প্রক্ষেপিত ঋণাত্মক ১ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ঋণাত্মক ৩ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপিত হয়েছে, যা বাজার তারল্যের ওপর এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ স্থিতির ওপর বর্ধিত চাপ আনতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থান তৈরি করে প্রবৃদ্ধি জোরদার করে অচিরে মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত উত্তরণের জন্য চলমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতায় উদ্ভব হওয়া সম্ভাবনাগুলো সদ্ব্যবহারে আমাদের আর্থিক খাতের বিবিধ করণীয়ের ওপর বরাবরের মতো এই পর্বের মুদ্রানীতি ঘোষণাপত্রেও আলোকপাত করা হয়েছে। এর মধ্যে করপোরেট খাতের অত্যধিক ব্যাংকনির্ভর মেয়াদি অর্থায়নকে ক্রমশ মূলধন বাজারে বন্ড ইস্যু করে অর্থায়নের দিকে মোড় ঘোরানোর চলমান প্রয়াসের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের মেয়াদি অর্থায়ন আহরণের সরলতর বিকল্পটির বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন ও প্রবর্তন এখন সময়োচিত হবে। অনেকগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় প্রতিবেশী দেশের মূলধন বাজার কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে বিধিব্যবস্থা প্রচলন করেছে। বাংলাদেশের মূলধন বাজারের সূচকের গতিধারা এখন আন্তর্জাতিক বাজারের সূচকের গতিধারার সঙ্গে বহুলাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মূলধন বাজারে বৈদেশিক পোর্টফোলিও বিনিয়োগ অন্তঃপ্রবাহ বৃদ্ধি সুগম করে আমাদের মূলধন বাজারের গতিশীলতা বৃদ্ধি করবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গণচীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের’ সঙ্গে দেশের সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বেশ কিছুটা বেড়েছে। তবে এর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জানানো হয়নি মুদ্রানীতিতে। এ ছাড়া নতুন বহুজাতিক অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক সচ্ছল দেশগুলোর সভরেন ওয়েলথ ফান্ড ও খ্যাতনামা বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আর্থিক খাত প্রতিষ্ঠানগুলোর এবং প্রকৃত খাতের বড় করপোরেটগুলোর যোগাযোগ ও সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ও পোর্টফোলিও বিনিয়োগ অন্তঃপ্রবাহ দ্রুত বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এই লক্ষ্যে দেশের আর্থিক খাত প্রতিষ্ঠানগুলোর এবং প্রকৃত খাতের শীর্ষস্থানীয় করপোরেটগুলোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ক্রেডিট রেটিংয়ের ভালো মান অর্জন ও বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ হবে। অচিরে মধ্যম আয়ের অর্থনীতি পর্যায়ে দেশের কাঙ্ক্ষিত উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় বর্ধিত বিনিয়োগ বহুলাংশে বৈদেশিক সূত্র থেকে আকর্ষণ করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে আমাদের আর্থিক খাতের সামর্থ্যের দ্রুত বিকাশের জন্য ব্যবস্থাপনা দক্ষতায় উৎকর্ষ আনার পাশাপাশি টাকার বাজার সুদহার ও বিনিময় হারে চাহিদা ও জোগানভিত্তিক পরিবর্তনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিবর্তনশীলতার ব্যত্যয় বাজার ব্যবস্থার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের দ্বিধাগ্রস্ত করার ঝুঁকি বাড়াবে। দেশের অভীষ্ট দ্রুত উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থেই যা এড়ানো বাঞ্ছনীয়।

মুদ্রানীতিতে বলা হয়, অর্থনীতির সার্বিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি নিম্নগামী মূল্যস্ফীতিকে আরো কিছুটা নিম্নতর মাত্রায় স্থিতিশীল করাই এক অঙ্কের বাজার সুদহার স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠার স্বীকৃত পথ। মুদ্রানীতির প্রথম মুখ্য উদ্দীষ্ট ভোক্তামূল্যস্ফীতি পরিমিত রাখার লক্ষ্য অর্জনে প্রথমার্ধের সাফল্য বেশ সন্তোষজনক। ২০১৮ সালের জুন শেষের ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ গড় বার্ষিক ভোক্তামূল্যস্ফীতি ডিসেম্বর শেষে ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশে দাঁড়ায়। যা জাতীয় বাজেটে প্রক্ষেপিত ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ ঊর্ধ্বসীমার নিচে। পূর্ববর্তী অর্থবছরের বন্যাজনিত ফসলহানির প্রতিকূলতা অতিক্রম করে খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত স্থানীয় উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এই সাফল্য অর্জনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। তবে মূল্যস্ফীতি পরিমিত রাখায় সতর্কতা শিথিল করার অবকাশ এখনো নেই।

মুদ্রানীতির দ্বিতীয় মূখ্য লক্ষ্য জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সমর্থন যোগানো। গত অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি এসেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেও মুদ্রানীতি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থন যোগাবে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর নাগাদ উৎপাদন কর্মকান্ডের জন্য উপকরণাদি আমদানির ১৭ দশমিক ৯২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং রপ্তানির ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। উৎপাদন কর্মকান্ডে কোনো বিঘ ব্যতিরেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকান্ডের ধারা আরও জোরালো হবে। আগের অর্থবছরে খাদ্যশস্য ও বড় বিনিয়োগ প্রকল্পে মূলধনী আমদানির আকষ্মিক উচ্চষ্ফীতির সূত্রে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি খাতে উদ্ভব হওয়া বড় ঘাটতি সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা ছিল চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রা ও আর্থিক নীতি কার্যক্রমের আরেকটি মূখ্য উদ্দীষ্ট। এই লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতিও সন্তোষজনক। বিগত অর্থ বছরের জুলাই-নভেম্ব্বর সময়কালের ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘাটতি চলতি অর্থবছরের একই সময়কালে ২ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ব্যাপক মুদ্রা ও অভ্যন্তরীণ ঋণের গতিধারা মুদ্রানীতি প্রোগ্রামে নির্দেশিত মাত্রার মধ্যেই থাকে এবং লেনদেন ভারসাম্যের চলতি খাতে ঘাটতি কমে আসার কারণে নীট বৈদেশিক সম্পদ এর হ্রাস প্রক্ষেপিত ঋণাত্বত ১ দশমিক ১ শতাংশের চেয়ে কমে ঋণাত্বক শূন্য দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়ায়। সরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। যা ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার থেকে বেশি। অপরদিকে পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিও সরকারের ঋণের সমান। এই প্রবৃদ্ধি মুদ্রানীতে প্রক্ষেপিত ১৬ দশমিক ৮ শতাংশের চেয়ে অনেকটা নীচে থাকে। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য অনিশ্চয়তার উৎকণ্ঠার একটি কারণ হয়ে থাকতে পারে।

এছাড়া, আমানত ও ঋণ সুদহারের যোগান ও চাহিদা ভিত্তিক ওঠানামায় সাম্প্রতিককালে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা বেসরকারি খাতে ঋণ যোগানের প্রবাহকে প্রভাবিত করছে কিনা সে বিষয়টিও অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে স্পষ্ট হবে। তবে কর্মসংস্থান সৃজনমুখী উৎপাদনশীল কর্মকান্ডের অগ্রাধিকারযুক্ত খাতগুলোয় অর্থায়ন যোগানের পর্যাপ্ততার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিবীক্ষণ ও সমর্থন আগে থেকেই বজায় রয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads