• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
অস্থিরতা চলছেই ব্যাংক খাতে

বাংলাদেশ ব্যাংক লোগো

ব্যাংক

অস্থিরতা চলছেই ব্যাংক খাতে

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ১০ মার্চ ২০১৯

সঙ্কট পিছু ছাড়ছে না দেশের ব্যাংক খাতে। ব্যবসা-বাণিজ্যকে গতিশীল করতে ঋণের সুদহার কমানোর প্রতিশ্রুতি থাকলেও সেটি কার্যকর হয়নি। আমানত প্রবাহ কমে যাওয়ায় চলছে নগদ টাকার টানাটানি। ডলার সঙ্কট থেকে গ্রাহকের ঋণপত্র খুলতে চাচ্ছে না অনেক ব্যাংক। কেউ কেউ ঋণপত্র খুললেও দায় পরিশোধ করতে চাচ্ছে না। খেলাপি ঋণের উচ্চ পরিমাণ রক্তাক্ত করছে পুরো খাতকে। বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতি। সঙ্কট থেকে মূলধন খেয়ে ফেলছে কোনো কোনো ব্যাংক। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সঙ্কটের মূল কারণ সুশাসনের ঘাটতি। তফসিলি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সুশাসন নিশ্চিত করতে পারছে না। অনেক সময় মিলেমিশে অনিয়ম ও জালিয়াতি করার অভিযোগও উঠছে তদের বিরুদ্ধে। কৌশলে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে যাচ্ছেন অনেক গ্রাহক। তথ্য আসছে, একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্র ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার করছেন। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে ভবিষ্যতে আরো গভীর সঙ্কট তৈরি হতে পারে। বিদ্যমান সঙ্কটের সাময়িক সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার নানা সহায়তা দিলেও তাতে কোনো সুফল আসছে না। কারণ সাময়িক সমাধান দিয়ে এই খাতের সঙ্কট দূর হবে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রবল মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এই মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য সম্প্রতি দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে চাহিদা মোতাবেক। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক সরকারের কাছে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। ঘাটতি পূরণের সবচেয়ে বেশি অর্থ চেয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। এজন্য ব্যাংকটির প্রয়োজন ৭ হাজার ৯৩৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এরপরের অবস্থানে রয়েছে জনতা ব্যাংক। এই ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি পূরণে প্রয়োজন ৬ হাজার কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের দরকার ৪ হাজার কোটি টাকা। আর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক মূলধন ঘাটতি পূরণে চেয়েছে ৭৭৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সরকারি অংশ পূরণেও প্রয়োজন আরো এক কোটি ১২ লাখ টাকা। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে মূলধন ঘাটতি পূরণে এই অর্থ চাওয়া হয়েছে।

সূত্র বলছে, পরিস্থিতির উত্তরণে গত এক বছরে বেশ কিছু ছাড় দিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ করে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার টানাটানি দূর করতে দেওয়া হয়েছে বিশেষ ছাড়। তবে কার্যত পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। আরো কিছু ছাড় দেওয়ার প্রক্রিয়া সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। এসব ছাড় নিয়ে ব্যাংকগুলো সাময়িকভাবে আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে পারছে। তবে বিনিয়োগকারীরা এখনো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের জোগান পাচ্ছে না। কমেনি ঋণের সুদহার। ফলে উচ্চ সুদে বিনিয়োগ করে ব্যবসায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। ব্যাংকের দায় পরিশোধ করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। তাছাড়া ব্যবসায়ের পরিবেশ নিয়েও অসন্তুষ্টি রয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। তবে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার চাচ্ছে, বেসরকারি খাত অর্থনীতির চালকের আসনে আসুক। এজন্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাকে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনার ১৫ মাসের সময়সীমা শেষ হওয়ার কথা চলতি মাসে। কিন্তু এখানেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার এ নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেখানে ঋণ আমানত অনুপাত সমন্বয় করতে আরো ৬ মাস সময় দেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানতের অনুপাত ৮৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে না এখনই। এখনো অনেক ব্যাংক নির্ধারিত সীমার চেয়ে অনেক ওপরে রয়েছে। বিশেষ করে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের এ সীমা ৯৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। যাদের ৮৫ শতাংশে নামতে হবে।

গত এক বছরে ব্যাংক খাতে আমানত প্রবাহ বাড়েনি বরং কমেছে। এর ফলে অনেকের পক্ষেই বাড়তি বিনিয়োগ সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। ব্যাংকাররা বলছেন, পরিস্থিতি ততদিন উন্নতি হবে না, যতদিন সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো যাবে না।

সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির ব্যাপারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাজেটে মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য অর্থ বরাদ্দ রয়েছে মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলো চেয়েছে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা কখনো দেওয়া সম্ভব নয়।

এদিকে ব্যাংক খাতের ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ১৫টি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। আগের বছরের ডিসেম্বর শেষে ঘাটতি ছিল নয়টি ব্যাংকে। আর তিন মাস আগে গত সেপ্টেম্বরে ঘাটতিতে ছিল ১৩ ব্যাংক। প্রভিশন ঘাটতি রেখে সাধারণভাবে কোনো ব্যাংক তার শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা দিতে পারে না। আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে সব ধরনের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত হারে প্রভিশন রাখতে হয়। সাধারণ ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখার নিয়ম রয়েছে। আর যথাসময়ে আদায় না হওয়া নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ বা ক্ষতিমানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে যথাক্রমে ২০, ৫০ ও ১০০ ভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

ব্যাংকগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে এ অর্থ রাখতে হয়। প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সাধারণভাবে লভ্যাংশ দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও বিশেষ অনুমোদন নিয়ে অনেক ব্যাংক ধাপে ধাপে প্রভিশন রাখার শর্তে কেউ কেউ লভ্যাংশ দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর সার্বিকভাবে ৫৭ হাজার ৪৩ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। তবে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে ৫০ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৬ হাজার ৬১৪ কেটি টাকা। ১৫টি ব্যাংক ঘাটতিতে থাকলেও বেশ কয়েকটি ব্যাংকে এক টাকাও প্রভিশন উদ্বৃত্ত নেই। এসব ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। এর বাইরে কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য হলেও বেশি প্রভিশন রাখতে পেরেছে। আর ঘাটতিতে থাকা ১৫ ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় নয় হাজার ৫২৩ কোটি টাকা কম রাখতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার চার ব্যাংকের ঘাটতি ৭ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। বেসরকারি ১১ ব্যাংকে এক হাজার ৬৪০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, তিন মাস আগের তুলনায় গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ কমে ৯৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। এটা ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। তিন মাস আগে ছিল ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা।  এক বছরের ব্যবধানে, অর্থাৎ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা বেড়েছে। অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় এক লাখ ৩৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। তিন মাস আগে যা ছিল ৪৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমে ৩৮ হাজার ১৪০ কোটি টাকা হয়েছে। তিন মাস আগে ছিল ৪৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল দুই হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। আর বিশেষায়িত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কমে চার হাজার ৭৮৮ কোটি টাকায় নেমেছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল পাঁচ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঙ্কট থেকে ঋণের সুদহার বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ব্যাংকের শিল্প ঋণের সুদহার ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠে গেছে, যেখানে আগে ছিল সাড়ে ১২ শতাংশ। ঋণের সুদহার বাড়তে থাকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ব্যবসায়ীরা। কারণ নানা কারণে বিনিয়োগ ব্যয় বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার বেড়ে গেলে ব্যবসায় ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের পণ্যের মূল্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে। এমন অবস্থায় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছেন। সর্বশেষ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও ঢাকা চেম্বারের নেতারা গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে তারা ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি ব্যাংকারদের রয়েছে তা কার্যকর করতে উদ্যোগ নিতে বলেছেন। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও বাজারে টাকার সঙ্কট কাটাতে আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নগদ জমার হার ১ শতাংশ কমিয়ে নেয় ব্যাংকগুলো। এর ফলে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা চলে যায় ব্যাংকগুলোর হাতে।

জানতে চাইলে একটি সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, গত ১৪ মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমেনি, বরং বেড়েছে। কমছে আমানত প্রবাহ। পরিস্থিতি কোথায় যাচ্ছে বলা মুশলিক। গ্রাহককের একটি আস্থার সঙ্কট দেখা দিতে শুরু করেছে। এখন গ্রাহকরা ব্যাংকে টাকা নিরাপদ কি না সেটি জানতে চান আগে।

তবে খেলাপি ঋণ কমাতে এরই মধ্যে ঋণ অবলোপন শর্ত শিথিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যবসায়ীরা যাতে গৃহীত ঋণের শূন্য ডাউন পেমেন্ট করে ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারেন তারও উদ্যোগ বিবেচনায় রয়েছে।  

অপরদিকে চাহিদার চেয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে গেছে। এতে ব্যাংকগুলোতে ডলার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ সঙ্কট মেটাতে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এতে তাদের সমস্যা আরো বাড়ছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে আরো নাজুক হবে। ব্যাংক থেকে টাকা বিভিন্ন কৌশলে একটি অসাধুচক্র বের করে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে ভালো বিনিয়োগকারীরা ঋণ পাচ্ছে না। এখন তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, ঋণের অর্থ পাচার হচ্ছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads