• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ব্যাংকের মুনাফায় কারসাজি

লোগো ব্যাংক

ব্যাংক

ব্যাংকের মুনাফায় কারসাজি

# প্রকৃত আর্থিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না # লাভবান হচ্ছেন মালিকরা ঝুঁকিতে আমানতকারী

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ০১ এপ্রিল ২০১৯

তফসিলি ব্যাংকের মুনাফায় চলছে শুভঙ্করের ফাঁকি। নানা কারসাজির মাধ্যমে কিছু ব্যাংক মুনাফাকে স্ফীত করছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য কৃত্রিমভাবে ভালো দেখিয়ে উদ্যোক্তা পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডাররা উচ্চ মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। এর ফলে ঝুঁকি বাড়ছে আমানতকারীদের। ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন চিত্র উঠে এসেছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তফসিলি ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক যাচাই-বাছাই করে লভ্যাংশ অনুমোদন দেওয়ার কথা। তবে সেটি সঠিকভাবে হচ্ছে না। কেবল কাগজের তথ্যে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে লভ্যাংশ ঘোষণার আবেদন।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তফসিলি ব্যাংকগুলো তার শেয়ারহোল্ডারদের উচ্চ মুনাফা দিতে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময়ই খেলাপি ঋণ সঠিকভাবে হিসাব করা হচ্ছে না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের মত, খেলাপি ঋণের যে তথ্য ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দিচ্ছে তা সঠিক নয়। ফলে ব্যাংকের পুরো আর্থিক কাঠামোর চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া গেলে বেশিরভাগ ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়বে। দেখা দেবে মূলধন সঙ্কট। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো নানা উপায়ে হিসাবের কারসাজি করে থাকে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ব্যাংকগুলো আয়ের খাতে নিতে পারে না। এটি আলাদা হিসাবে রাখতে হয়। খেলাপি ঋণ আদায় হলে এর বিপরীতে আয় মুনাফা হিসেবে দেখাতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যাংকই বার্ষিক মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য খেলাপি ঋণের বিপরীতে স্থগিত আয় মুনাফা হিসেবে দেখিয়ে আসছে।

অপরদিকে মেয়াদি আমানতের বিপরীতে বার্ষিক সুদ বা মুনাফার অংশ পরিশোধ হিসেবে প্রভিশন করতে হয়। কোনো কোনো ব্যাংক ওই পে-অ্যাবল (পরিশোধযোগ্য) হিসাবে রাখা টাকাকে আয়ের খাতে প্রদর্শন করছে। এছাড়া ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য আয় নির্ধারণে ‘রিসিভেবল’ হিসেবে টাকা রাখা হয়। ভবিষ্যতে আয় হতে পারে এমন একটি অঙ্ক রিসিভেবল আয় হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু ওই অঙ্কেই আয় প্রকৃতপক্ষে না হলেও তা আয় হিসেবে প্রদর্শন করছে ব্যাংকগুলো। এতেও বাড়ছে মুনাফা। এভাবে মুনাফা বাড়াতে নানা কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলোর আর্থিক চিত্র জানতে বিশেষ পরিদর্শন শুরু হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি দুই ধরনের ব্যাংক বিশেষ পরিদর্শনের আওতায় আসছে। আমরা নিয়মিতভাবে ব্যাংকগুলো থেকে তথ্য নিয়ে থাকি। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লভ্যাংশ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এখানে কেউ কারসাজি করে থাকলে এবং তদন্তে বেরিয়ে এলে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে ব্যাংকগুলো বোনাস শেয়ারের পরিবর্তে নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার দিকে ঝুঁকছে। গত বছর দেড় ডজন ব্যাংক নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ইউসিবিএল, ওয়ান ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, নগদ লভ্যাংশের দিকে বেশি ঝুঁকছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণ ও মুনাফার হিসাবে সাধারণত তদারকি সরাসরি করা হয় না। বিগত দিনে এবি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক সরেজমিন তদন্তে গিয়ে ব্যাংকের দেওয়া তথ্যে গরমিল পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ ও আয় সমন্বয় করতে গিয়ে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের প্রকৃত আয়। ফলে সব মিলে বছর শেষে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ পরিচালন মুনাফা করছে তা লোকসানে চলে যাচ্ছে। ফলে অনেক ব্যাংক লোকসান করছে। আর এভাবেই প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহকরা।

ব্যাংকের মুনাফার জালিয়াতি বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মুনাফার জালিয়াতি ঠেকাতে না পারলে ডিভিডেন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকের মূলধন ক্ষয় হয়ে যাবে। আর এর প্রভাব শুধু ব্যাংকিং খাতেই নয়, পুরো অর্থনীতিতে পড়বে।

নগদে লভ্যাংশ দিয়ে মূলধন হারাচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। আবার কোনো কোনো ঋণ আদায় না করেই আদায় দেখানো হচ্ছে। এতেও বাড়ছে মুনাফা। নানা কারসাজির মাধ্যমে প্রতিবছরই কিছু কিছু ব্যাংক মুনাফাকে স্ফীত করছে। আর এ মুনাফার ওপর ভর করেই নগদে লভ্যাংশ দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নগদে লভ্যাংশ দেওয়ার অনুমোদন কোনোভাবেই ঠিক হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো এমন আবেদন করলেও তা অভ্যন্তরীণ পরিদর্শনে গিয়ে তদন্ত করা উচিত। কারণ, ব্যাংকগুলো যথাযথভাবে প্রভিশন সংরক্ষণ করছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বলেন, কৃত্রিম মুনাফার ওপর ভর করে নগদ লভ্যাংশ দেওয়ায় তা ব্যাংকগুলোর জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। কারণ, নগদ আদায় না করেও নগদে আদায় দেখিয়ে মুনাফা বাড়ানো হচ্ছে। এতে সম্পদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় আমানতকারীদের আমানত ফেরত দেওয়ার মতো অর্থ ব্যাংকগুলোর কাছে থাকবে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads