• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
এত ডলার যাচ্ছে কোথায়

এত ডলার যাচ্ছে কোথায়

প্রতীকী ছবি

ব্যাংক

এত ডলার যাচ্ছে কোথায়

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৩ এপ্রিল ২০১৯

ডলার সঙ্কটে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। আর এ অবস্থার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা। যে কারণে সময়মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আনতে না পারায় খরচ বাড়ছে ব্যবসায়।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাজারে ডলার ছাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তাতেও স্থিতিশীল হচ্ছে না বাজার। বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম আর কমছে টাকার মান। ফলে প্রশ্ন উঠছে, ‘এত ডলার কোথায় যাচ্ছে?’ ডলার সঙ্কট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ঠিক সময়ে বিদেশি ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে অনেক এলসি। গুনতে হচ্ছে জরিমানা।

জানা যায়, ডলারের বেশি চাহিদার মধ্যে মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা কমাতে ডলার ছেড়েই চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ১৫৫ কোটি ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রিও করা হয়েছে। তাতে খুব বেশি লাভ হয়নি। কোনো কোনো ব্যাংক ৮৪ টাকার বেশি দামেও ডলার বিক্রি করেছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান গত এক বছরে ক্রমাগত কমছে। তাতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয়ে ‘ইতিবাচক’ প্রভাব পড়লেও আমদানিতে খরচ বেড়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি বাড়ার কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু আমদানির তথ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচারকেও এর একটি কারণ বলে মনে করছেন তাদের কেউ কেউ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকগুলো যে দরে ডলার বা অন্য মুদ্রা কেনাবেচা করে, তাকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বিনিময় হার বলা হয়। ব্যাংকগুলো এর চেয়ে এক থেকে দেড় টাকা বেশি দামে ডলার গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে। গত এক বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। ছয় মাসের ব্যবধানে কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সাড়ে ছয় মাসে ১২৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অথচ গত অর্থবছরের এই সময়ে বাজার স্থিতিশীল থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কোনো ডলার বিক্রি করতে বা কিনতে হয়নি। ওই কর্মকর্তা বলেন, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সময়মতো বিদেশি ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করাও এখন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ এলসি।

ডলার সঙ্কট নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আগের বছরে ব্যাপকহারে আমদানি হওয়ায় এখন ডলার সঙ্কট হচ্ছে। ওই সময় রফতানির চেয়ে আমদানি অনেক বেশি ছিল। তবে বর্তমানে রফতানির প্রবৃদ্ধি ভালো হচ্ছে। আমদানিও কমতে শুরু করেছে। শিগগিরই অবস্থার উন্নতি হবে বলে তিনি মনে করছেন। তবে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় থাকার কোনো বিকল্প নেই। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, রফতানি, রেমিট্যান্স আয়ের সঙ্গে আমদানি ব্যয়ের একটা অসামঞ্জস্য হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এর ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর চাহিদা অনুযায়ী ডলারও দিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬১২ কোটি ৮ লাখ ডলার। জানুয়ারি মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশ থেকে অর্থ পাচারের একটি পথ হচ্ছে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস দেখানো। অর্থাৎ যে দামে পণ্য কেনা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে বাড়তি অর্থ বিদেশে পাচার হয়। আবার যে পণ্য আমদানি হওয়ার কথা, তার বদলে কম দামি পণ্য আনা অথবা খালি কন্টেইনার আনার ঘটনাও ধরা পড়েছে কখনো কখনো। আবার পণ্য রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়। যে পণ্যের দাম ১০০ ডলার, ক্রেতার সঙ্গে বোঝাপড়া করে তা ৭০ ডলার দেখিয়ে রফতানি করেন ব্যবসায়ী। বাকি ৩০ ডলার তিনি বিদেশে সেই ক্রেতার কাছ থেকে নিয়ে তা বিদেশেই রেখে দেন।

এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের ধারণা, আমদানি বাড়ার পাশাপাশি ‘প্রচুর অর্থ’ বিদেশে পাচার হচ্ছে। আহসান মনসুর বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এটা হয়ে আসছে। কোনো কারণে অনিশ্চয়তা বাড়লে অর্থ পাচারের প্রবণতাও বাড়ে। তিনি বলেন, বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে মূলত তিন ভাগে। প্রবাসীদের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স দেশে আসার কথা, সেটা না এসে তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে তা কানাডা-আমেরিকায় চলে যাচ্ছে। যে রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হওয়ার কথা, তা দেশে না এসে বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

যদিও ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১৫৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। যার ফলে ডলার বিক্রি করায় কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বর্তমানে রিজার্ভ কমে প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি (৩১ বিলিয়ন) ডলার হয়ে গেছে। যেখানে গত বছর একই সময়ে তিন হাজার ২২৭ কোটি (৩২ বিলিয়ন) ডলার ছিল। গত বছরের ২১ মে থেকে ডলার ৮৩ টাকা ৭০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। পরে ২৮ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক ডলারের মূল্য ছিল ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে এখন ৮৪ টাকা ৪০ পয়সা হয়ে গেছে।

এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে যে দামে ডলার বেচাকেনা করে, তা আন্তঃব্যাংক দাম হিসেবে বিবেচিত। টাকা-ডলার বিনিময় হার গত বছরের একই সময়ে ছিল ৮২ টাকা ৯৬ পয়সা। সে হিসাবে এক বছরে ডলারের দাম এক টাকা ১৯ পয়সা বেড়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads