• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
শৃঙ্খলা নেই ব্যাংকে তারল্য ব্যবস্থাপনায়

প্রতীকী ছবি

ব্যাংক

শৃঙ্খলা নেই ব্যাংকে তারল্য ব্যবস্থাপনায়

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ০৬ মে ২০১৯

দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। নগদ টাকার টানাটানি, আমানতের সুদহার, ঋণের সুদহার, মূলধন ঘাটতি উসকে দিচ্ছে এই বিশৃঙ্খলাকে। ফলে বিনিয়োগকে চাঙ্গা করতে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও কার্যকর সুফল আসছে না। টাকার সঙ্কট মেটাতে বেশির ভাগ ব্যাংক উচ্চ সুদে স্বল্প মেয়াদে আমানত সংগ্রহ করছে। কিন্তু বিনিয়োগ করা হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদে। ঋণ আমানতের এ বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে ব্যাংকিং খাতে তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি খাতের উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক। যে কোনো ধরনের অর্থায়নের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল দেশের বিনিয়োগ। এটা অনুধাবন করা জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক বড় উৎস হতে পারে না। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অতীতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সেগুলো সাফল্য নিয়ে আসতে পারেনি। এ জন্য পুঁজিবাজারে শক্তিশালী ও কার্যকর বন্ড মার্কেট চালু করা দরকার। এর মাধ্যমে অবকাঠামো খাতের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট প্রবর্তনে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

সূত্রগুলো বলছে, পুঁজিবাজারের সূচকে ওঠা-নামা স্বাভাবিক একটি ধর্ম। এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীকে সচেতন হতে হবে। এখান থেকে অর্থ তুলে বিনিয়োগ করা হবে দেশের উন্নয়নে। গতিশীল বন্ড মার্কেট বিকাশের জন্য পুঁজিবাজারকে অবশ্যই কার্যকর রাখতে হবে।

বর্তমানে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব। দেশের বেসরকারি খাতকে এ বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত করতে বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নতি দরকার।

জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ওসামা তাসীর বলেন, বিগত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সবার কাছে উদাহরণ। এদেশ এখন দ্রুততম সময়ে বিকাশমান অর্থনীতির ৫টি দেশের মধ্যে অন্যতম। এই ধারা বজায় রেখে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৮ দশমিক ১৩। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে আর্থিক খাতের শক্তিশালী অবস্থান জরুরি।

এ ক্ষেত্রে অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের ওপর বিশেষ জোর দেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের বিষয়গুলো অনেকটাই বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি) তথা সরকারি খাতের অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল। দ্রুততম সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে যেতে হলে প্রয়োজন অবকাঠামোর উন্নয়ন।

বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের জন্য এ খাতে ৩২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ দরকার। বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের জন্য ব্যাংক খাত যথোপযুক্ত উৎস নয়। বরং পুঁজিবাজার, বন্ড মার্কেট, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড এবং পেনশন ফান্ডের মতো বিবিধ উৎস এ ক্ষেত্রে মুখ্য চালিকাশক্তির ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। পুঁজিবাজার এবং সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন করা দরকার যাতে সবার সমন্বয়ে অবকাঠামো খাতে সহজেই অর্থায়ন করা যায়।

বাংলাদেশ বন্ড মার্কেটবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সাল থেকে ২০৪০ সালের মধ্যে অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য দেশের ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ দরকার। পানি, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, নদীবন্দর, বিমানবন্দর, রেল ও সড়কপথের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এ অর্থ প্রয়োজন। যদিও বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, এই প্রয়োজনীয় অর্থের মধ্যে ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবস্থা করা যাবে। বাকি ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদে আমানত নিয়ে বিনিয়োগ করার কথা। কিন্তু ব্যাংকগুলো করছে বিপরীত কাজ। স্বল্প মেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করছে। একসময় আমানতকারীদের আমানত নির্ধারিত মেয়াদ শেষে ফেরত দেওয়া ব্যাংকগুলোর জন্য কষ্টকর হচ্ছে।

এদিকে ব্যাংকিং খাতে তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কারো কাছে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। অপরদিকে কোনো কোনো ব্যাংক রয়েছে গভীর তারল্য সঙ্কটে। তবে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ৭৯ হাজার কোটি টাকা।

২০১৭ সালে আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করায় নগদ টাকার সঙ্কটে পড়তে হয় দেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংককে। এর ঢেউ এসে আঘাত করে পরের অর্থবছরেও। বর্তমানে নিজ প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থও নেই অনেক ব্যাংকের। টাকা ধার নেওয়ার এ তালিকায় আছে— এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল, অগ্রণী, সিটি, ওয়ান, ইউনিয়ন, এনসিসি, প্রিমিয়ার, প্রাইম, স্ট্যান্ডার্ড, এনআরবি ও উত্তরা ব্যাংক।

জানতে চাইলে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, নতুন আমানত আসছে কম। অথচ ঋণ দেওয়ার চাপ রয়েছে। এতে অনেক ব্যাংক হয়তো এসএলআরের অতিরিক্ত বিল ও বন্ড নগদায়ন করে ফেলছে।

এদিকে ব্যাংক খাতের ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ১৫টি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। আগের বছরের ডিসেম্বর শেষে ঘাটতি ছিল নয়টি ব্যাংকে। আর তিন মাস আগে গত সেপ্টেম্বরে ঘাটতিতে ছিল ১৩ ব্যাংক। প্রভিশন ঘাটতি রেখে সাধারণভাবে কোনো ব্যাংক তার শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা দিতে পারে না। আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে সব ধরনের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত হারে প্রভিশন রাখতে হয়। সাধারণ ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখার নিয়ম রয়েছে। আর যথাসময়ে আদায় না হওয়া নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ বা ক্ষতিমানে শ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে যথাক্রমে ২০, ৫০ ও ১০০ ভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বেসরকারি খাতের উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণসুবিধা নিশ্চিত করা আবশ্যক। আমরা যে কোনো ধরনের অর্থায়নের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। কিন্তু এটা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি যে, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক সঠিক উৎস নয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads