• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ঋণগ্রহীতাদের বিশেষ সহায়তা ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি

বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো

ফাইল ছবি

ব্যাংক

ঋণগ্রহীতাদের বিশেষ সহায়তা ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ২২ মে ২০১৯

ঋণগ্রহীতাদের বিশেষ সহায়তা দিতে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করলেও তাতে শুভঙ্করের ফাঁকি বেরিয়ে আসছে। অথচ দেশের বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবসাকে চাঙ্গা করতে ঋণগ্রহীতাদের বিশেষ সহায়তা দেওয়ার অংশ হিসেবে নেওয়া হয়েছিল এই উদ্যোগ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তা পর্যালোচনা করে অসংখ্য ক্রটি-বিচ্যুতি পাওয়া গেছে। এমন পর্যালোচনার মধ্যেই ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারের ওপর ২৪ জুন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা জারি করেছেন উচ্চ আদালত।

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এখানে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সহায়তা দেওয়া হলেও টানাটানি ও ব্যবসায়িক লোকসানের মধ্যে যেসব বিনিয়োগকারী ঋণ নিয়মিত করেছেন তাদের জন্য নেই ভালো খবর। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, ডিসেম্বর শেষে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার পুরনো ঋণ নিয়মিত করে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করতে অনেকে ধার করেছেন। অনেকে সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছেন। ফলে তারা সরকারের এই বিশেষ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা ছিল। ওই সার্কুলার স্থগিত চেয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদের করা এক আবেদনের শুনানি করে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এই আদেশ দেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে মনজিল মোরসেদ নিজেই শুনানি করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন মো. মনিরুজ্জামান।

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তাই প্রজ্ঞাপনের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে অসন্তুষ্ট। তারা উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব কর্মকর্তা বলছেন, প্রজ্ঞাপনে অনেক ত্রুটি ছিল। এখানে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে যেসব ঋণ খেলাপি হয়েছে তারাই কেবল আবেদন করতে পারবে। কিন্তু ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগ করে পুরনো ঋণ নিয়মিত করতে কিংবা পরিশোধ করতে। ফলে অনেক গ্রাহক নতুন করে ঋণ করে কিংবা সম্পদ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেন অথবা নিয়মিত করে নেন। ফলে সেসব ঋণ আর খেলাপি হিসেবে শনাক্ত হবে না। এমন ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা, যার বড় অংশই হয়তো ব্যবসায়িক লোকসানের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বলা হয়েছে। ফলে এরপর মার্চ প্রান্তিক শেষে যারা খেলাপি হবেন তারাও এই প্রজ্ঞাপনের সুফল পাবেন না। তবে একটি গোষ্ঠী ব্যবসায়ী প্রজ্ঞাপনের সুফল হয়তো পেতেন। এতে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে মূলধন জোগানও বাড়বে। তবে তাতে সরকারের উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য, তা অর্জন হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আদালতের স্থগিতাদেশ হাতে পেলে তা পর্যালোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করা হবে।

এদিকে আদালতের আদেশের পর মনজিল মোরসেদ বলেন, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা ওই সার্কুলারকে আদালত ‘দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে গত ১৬ মে আদালতে গিয়ে বলেছিলাম, এ সার্কুলারটি স্থগিত করা হোক। সে সময় শুনানিতে আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবীকে জিজ্ঞেস করেছিল এ ধরনের সার্কুলার হয়েছে কি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হলো, এ ধরনের কোনো সার্কুলার হয়নি।

আদালত সে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদন মঞ্জুর না করে বলেছিল, তালিকা দিতে হবে। আগামী ২৪ জুন পর্যন্ত তাদের সময় দেন আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ মে বিকালেই বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। সেটিই রোববার আমরা চ্যালেঞ্জ করে স্থগিত চেয়েছি।

মনজিল মোরসেদ আরো বলেন, ২ শতাংশ দিয়ে তারা ঋণ খেলাপির তালিকা থেকে মুক্তি পাবে, সিআইবিতে নাম থাকবে না, তখন ব্যাংক থেকে নতুন করে আবার হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যাবে, তাতে ব্যাংকের মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে।

এই আইনজীবী জানান, এর পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা আবেদন জানিয়েছিলাম যে, সার্কুলারটা মামলার শুনানি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখা হোক। আদালত ২৪ জুন পর্যন্ত এ সার্কুলারের কার্যক্রমের ওপর স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। ওই দিন পরবর্তী আদেশ হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তালিকা দেওয়ার পর।

আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সার্কুলার নিয়ে কী বলেছে, জানতে চাইলে মনজিল বলেন, মন্তব্য তো করেছেন অনেক। বলেছেন এই সার্কুলার বাংলাদেশ ব্যাংকের দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন। আবার বলেছেন যে, যারা ঋণখেলাপি, তাদের পক্ষে কাজ করার জন্য ব্যাংক উঠেপড়ে লেগেছে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে পাচার করা হচ্ছে, অথচ এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই। আবার যদি তারা সুযোগ পায় তাহলে তারা আরো এক লাখ কোটি টাকা নিয়ে যাবে।

সরকার ব্যাংকগুলোকে ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দিলেও ব্যাংকগুলো যে তা মানছে না, সে বিষয়টিও শুনানিতে এসেছে বলে মনজিল মোরসেদ জানান।

তিনি বলেন, তারা তো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও মানছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্যই দেখা যাচ্ছে, যারা লুটপাট করছে টাকা-পয়সা লোন নিয়ে পরিশোধ করছে না, তাদের সাপোর্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংক নেয়। এটাই বলেছেন আদালত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রজ্ঞাপনে ঋণ নিয়মিতকরণের যে প্রক্রিয়া দেওয়া হয়েছে তাতেও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে। ব্যাংকের এক শ্রেণির অসাধু পরিচালক সক্রিয় হয়ে অনেক গ্রাহকের কাছ থেকে অবৈধভাবে ফায়দা নিতে চেষ্টা করবেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আদালতের আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখনই এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না।

বাংলদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে অনিয়মিত ঋণের সুদহার হবে ৯ শতাংশ। কিন্তু নিয়মিত ঋণের সুদহার এখনো ১৫-১৭ শতাংশ। আমানত সঙ্কট গভীর হচ্ছে নতুন করে। ফলে ঋণের সুদহার শিগগিরই কমার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads