• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
বড় গ্রাহকে জিম্মি ব্যাংক

ছবি : সংগৃহীত

ব্যাংক

বড় গ্রাহকে জিম্মি ব্যাংক

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ৩০ মে ২০১৯

বড় ঋণ গ্রহীতাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে পুরো ব্যাংক খাত। অর্থনীতিবিদসহ বিশ্লেষকরা সমালোচনা করলেও বছরের পর বছর বড় গ্রাহকদের নিয়ে ব্যবসাকে ঝুঁকিতে ফেলছে বেশিরভাগ ব্যাংক। অবশ্য ব্যাংকারা বলছেন, দেশের অর্থনীতি এখন যে পর্যায়ে আছে সেখান থেকে বড় উল্লম্ফন দিতে বড় ধরনের শিল্প ও বিনিয়োগকে সামনে আনতে হবে। এতে যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে, তেমনি বাড়বে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, যা সরকারের ঘোষিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সমন্বিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, বর্তমানে সাড়ে আট লাখ কোটি টাকার ঋণের সিংহভাগ ঋণ পুঞ্জীভূত কতিপয় গ্রাহকের কাছে। প্রায় সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা বড় গ্রাহকদের ঋণ হিসেবে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। তারা অনেকে ব্যাংকের দায় পরিশোধ করতে পারছেন না বলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। আর এসব ঋণ আদায়ে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত আদালতে আটকে গেছে। আগামী ২৪ জুন পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন আদালত।

বড় গ্রাহকদের কাছে ঋণ দিয়ে ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আর এ কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে দেওয়া বড় অঙ্কের ঋণের বেশির ভাগই কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে। এমনকি বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করা ১১টি শিল্প গ্রুপও তাদের ঋণ পরিশোধ করছে না। এতে ব্যাংকিং খাতে পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর লোকসানের পরিমাণ।

গত ২০ মে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেখানে বড় আকারের খেলাপি ঋণ ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিয়ে পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়। পুনঃতফসিল করার পর এক বছর দেওয়া হয় গ্রেস পিরিয়ড়। তারপর দশ বছরে ঋণের অর্থ পরিশোধ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এমন ঘোষণায় খেলাপি হয়ে পড়া বড় ঋণগ্রহীতারা কিছুটা স্বস্তি পেলেও শেষ পর্যন্ত নানা কারণে হতাশ হয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র বলছেন, আদালত স্থগিতাদেশ দিলেও গ্রাহকরা এখন দ্বিধায় পড়েছেন। তারা কি পুরনো ঋণ নিয়মিত করে ফেলবেন নাকি সুবিধা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবেন— এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন তারা।

জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ, আদায়, অডিট আপত্তি ও মামলাসংক্রান্ত একটি বৈঠক ডেকেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আগামীকাল সকাল ১১টায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে তাদের বিশদ তথ্যসহ থাকতে বলা হয়েছে।

একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মর্কতা আলাপকালে গতকাল জানান, বড় গ্রাহককের ঋণ আমাদের জন্য চিন্তা বাড়িয়েছে এটা ঠিক। তবে সরকারের যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তাতে আমাদের এখন বড় শিল্প কারখানাতে যেতেই হবে। আগামী ৫ বছরে সরকার মোট দেশজ উৎপাদন দুই অঙ্কর ঘরে নিতে চায়। এর জন্য ছোট ছোট বিনিয়োগ দিয়ে হবে না। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময়সীমা ২০৩০। এজন্যও আমাদের ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। তাই এখন আমাদের ভারী শিল্পের দিকে যেতে হবে। তবে ঋণ দেওয়ার আগে সর্তক থাকতে হবে, যাতে সেটি যথাযথ ব্যবহার হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

বড় অঙ্কের ঋণের সংজ্ঞায়, কোনো ব্যাংকের মোট মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি কোনো গ্রাহককে ঋণ দিলেই তা বড় অঙ্কের ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ বড় অঙ্কের ঋণ কোনো ব্যাংক একজন গ্রাহককে দিতে চাইলে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হতো। এর ফলে কোনো ব্যাংক কী পরিমাণ বড় অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবহিত থাকত। কিন্তু মুক্তবাজারের নামে একপর্যায়ে এ বিধান তুলে দেওয়া হয়। তখন থেকে ব্যাংকগুলো কোনো গ্রাহককে বড় অঙ্কের ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর অনুমোদন নিতে হয় না। ব্যাংকগুলো নিজেরাই ব্যাংক গ্রাহকের সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দিয়ে আসছে। তবে একক ঋণের সীমা অর্থাৎ কোনো ব্যাংকের মোট মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি কোনো একজন গ্রাহককে নগদ দিতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। এটিও হয়তো বাতিল হতে পারে এমন আভাস মিলেছে।

উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ সুবিধা দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে শিল্পগুলোর লোকসান কাঠিয়ে উঠবে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রেখে আয় উপার্জনের মাধ্যমে ঋণের অর্থ পরিশোধ করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা নেওয়ার পর তা আবার খেলাপি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানমতে, মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এবং সুদের ওপর বিশেষ ছাড় নিয়ে ১১টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ১৪ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় ওই ঋণ আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলোর পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকের মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে।

এদিকে বড় ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ দিতে উদার ব্যাংকগুলো ছোট গ্রাহকদের ঋণ দিতে চায় না। ফলে দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সঠিকভাবে বিকশিত হয়নি। অথচ আমাদের দেশের অর্থনীতিতে এই খাতের অবদান অনেক। রাজনৈতিক প্রভাব না থাকায় এসব গ্রাহক ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছেন না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads