• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ধরাছোঁয়ার বাইরে শীর্ষ খেলাপিরা

ছবি : সংগৃহীত

ব্যাংক

ধরাছোঁয়ার বাইরে শীর্ষ খেলাপিরা

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ১৯ আগস্ট ২০১৯

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রতিবছর বাড়ছে। তবে খেলাপি ঋণ থেকে আদায় সন্তোষজনক নয়। গত দুই বছরের অনুপাতে বরং আদায় কমছে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সতর্ক করেছে সরকার। খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায় বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছেন শীর্ষ ঋণখেলাপিরা। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যাংকের বড় ২০ ঋণখেলাপি থেকে আদায় বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ছয় ব্যাংক ও বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নিয়ে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। সেখানে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণসংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন উপস্থাপন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ। একই সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এই পরিমাণ দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

সোনালী ব্যাংক : সূত্র বলছে, মার্চ শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। কিন্তু গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায় দাঁড়িয়েছে ১৭১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ থেকে ব্যাংকটিকে মোট আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বিপরীতে নগদ আদায় হয় এক হাজার ৮ কোটি টাকা।

সরকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি থেকে ব্যাংকটি মাত্র ১১ কোটি টাকা আদায় করেছে। ২০১৮ সালে শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে মোট আদায় ছিল ১১৯ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অবশ্য ২০১৭ সালের থেকে বেশি। ২০১৭ সালে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি থেকে মোট আদায় ছিল ৩১ কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংক : এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বছর ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল সাত হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চ শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। বড় কয়েকটি ঋণখেলাপি হয়ে অবনতি ঘটেছে এই ব্যাংকের। ২০১৯ সালের প্রথম তিন মাসে খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায় দাঁড়িয়েছে ৪০৯ কোটি টাকা। অবশ্য এখানে অগ্রগতি হয়েছে। ২০১৮ সালে নগদ আদায়ের পরিমাণ ছিল ৪৮৪ কোটি টাকা। অবশ্য এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয় সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে। ২০১৮ সালে ব্যাংকটি শীর্ষ ২০ ঋণ খেলাপি থেকে আদায় করেছে ৯৯ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে আদায় হয়েছে আট কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংক : হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৭ সালে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল পাঁচ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। অবশ্য ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিকে শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে ব্যাংকটির আদায় হয়েছে মাত্র ৪০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল এক কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অবশ্য ২০১৭ সালে ব্যাংকটি শীর্ষ খেলাপিদের থেকে নগদ আদায় করেছিল প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অগ্রণী ব্যাংক ২০১৮ সালে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা নগদ আদায় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। কিন্তু বছর শেষে আদায় হয় ৩১৯ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের মার্চ শেষে ৭৬ কোটি টাকা আদায় করেছে এ ব্যাংক।

রূপালী ব্যাংক : চলতি বছরের মার্চ শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ ছিল চার হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ থেকে নগদ এক হাজার কোটি টাকা করার লক্ষ্য নিয়ে চুক্তি সই করে। তবে বছর শেষে আদায় হয় ১৮৫ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আদায় হয়েছে ২৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ২০১৮ সালে শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে নগদ আদায় করে পাঁচ কোটি টাকা। অবশ্য চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে এর পরিমাণ এক কোটি টাকার নিচে।

বেসিক ব্যাংক : রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন আট হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ছিল আট হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি থেকে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আদায় দাঁড়িয়েছে তিন কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ২১ কোটি টাকা। সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক, ২০১৮ সালে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ থেকে মোট এক হাজার ১৯৩ কোটি টাকা আদায় করবে বলে জানায়। তবে বছর শেষে আদায় হয় ১৪৮ কোটি টাকা। আর ২০১৯ সালের প্রথম তিন মাসে আদায় হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫৮ কোটি টাকা।

বিডিবিএল : বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) খেলাপি ঋণ ৯০১ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালে ছিল ৮৮৭ কোটি টাকা। এ ব্যাংক ২০১৮ সালে শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে নগদ আদায় করেছে ২৮ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিকে আদায়ের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ থেকে মোট আদায় হয় ৮৩ কোটি টাকা। আর ২০১৯ সালের প্রথম তিন মাসে হয়েছে সাড়ে ৯ কোটি টাকা।

বিকেবি : ২০১৯ সালের মার্চ শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে একই পরিমাণ খেলাপি ঋণ ছিল ব্যাংকটির। একই বছরে ৫৪৯ কোটি টাকা নগদ আদায় করে এ ব্যাংক। আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৮৪ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালে শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে আদায় করেছে চার কোটি টাকা।

রাকাব : রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২১১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালেও একই পরিমাণ খেলাপি ঋণ ছিল ছিল এ ব্যাংকের। ২০১৮ সালে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায় করে ১৭৫ কোটি টাকা। লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল ৩২৭ কোটি টাকা। শীর্ষ ২০ খেলাপি থেকে একই বছরে আদায় হয় ১৩ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, আমরা আসলে বড় ঋণখেলাপিদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছি। এখন চাইলেও হুট করে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। এছাড়া এদের অনেকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, এটিও আমাদের মেনে নিতে হয়। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।

অন্যদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেছেন, ব্যাংক খাতে বড় সংকট খেলাপি ঋণ। এর বড় অংশই কিছু গ্রাহকের হাতে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বৈঠক করে আমরা খেলাপি ঋণ থেকে আদায় বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছি। একই সঙ্গে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ কীভাবে আদায় করা যায়, সেদিকে যেতে বলা হয়েছে। এছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ে নতুন নির্দেশ জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে সব মিলিয়ে আশা করি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads