• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ব্যাংক

বেসরকারি ঋণে ভাটা

ঋণঝুঁকি নীতিমালার সংশোধনী চান ব্যাংকাররা

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ১২ নভেম্বর ২০১৯

ধারাবাহিকভাবে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমছে। বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিতে ভাটার মানে বিনিয়োগ থমকে আছে। এর মধ্যে বেসরকারি ঋণকে টেনে ধরছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার বেড়াজাল। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকাররা সংশ্লিষ্ট নীতিমালার সংশোধন দাবি করেছেন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একটি বিশেষ বৈঠকে এই প্রস্তাব করেছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, দুই বছর আগে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে যে ধারা ছিল তা এখন আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধিতে পতন ঘটছে। ২০১৭ সালে বেসরকারি ঋণে প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ শতাংশের কাছাকাছি। এ মুহূর্তে তা ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ২২ মাসের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে অর্ধেকে নেমেছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, উদ্যোক্তাদের চাহিদা থাকলেও পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ঋণ দিতে পারছে না বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। সে কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কম হচ্ছে। তার সঙ্গে রয়েছে উচ্চ সুদহার। এর সঙ্গে ঋণ বিতরণে নীতিমালার বেড়াজাল বড় হয়ে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের উন্নয়ন নীতির উল্টোপথে সামনে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমাল। দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার চাচ্ছে ব্যাপকভিত্তিক বেসরকারি বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা বিনিয়োগে লাগাম টানছে। ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং পদ্ধতি (আইসিআরআরএস) বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করছে। উদ্যোক্তা ও ব্যাংকারদের মতামত উপক্ষো করে গত পহেলা অক্টোবর থেকে নীতিমালাটি কার্যকর হয়। এর ফলে ঋণ পেতে বেড়েছে আমলতান্ত্রিক জটিলতা। ফলে নীতিমালাটি পুনরায় পর্যালোচনার দাবি উঠেছে। 

কেউ কেউ বলছেন, কয়েক বছর ধরে জিডিপি অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ একই জায়গায় রয়েছে। এর মধ্যে অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে আশানুরূপভাবে ঋণ বাড়াতে পারছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর বা অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও) নতুন সীমা নামানোর বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় দেওয়া হলেও ঋণ বাড়ছে না।

জানতে চাইলে এবিবির চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, নীতিমালাটি পরিপালন করতে গিয়ে কিছু বিষয় সামনে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তা তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, মার্চে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ, এপ্রিলে ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মে মাসে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ, জুনে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, জুলাইতে ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ, আগস্টে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ।

সাধারণের আমানতের অর্থ দিয়ে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু ঋণের বড় একটি অংশই আদায় হচ্ছে না। কিন্তু মেয়াদ শেষে সাধারণ আমানতকারীদের সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে নগদ টাকার প্রবাহের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। এরপরও ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়েই ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ তলানিতে চলে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার অর্থই হলো বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধাগ্রস্ত হওয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ৯ লাখ ১৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। আর ৩ মাস আগে জুন শেষে ছিল ১০ লাখ ১০ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। 

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলছেন, বিশদ এই নীতিমালা কার্যকর হলে উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে কোনো জটিলতা তৈরি হবে না। ভালো গ্রাহকরা ঋণ পাবেন। তাদের হয়রানির কোনো সুযোগ নেই। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও হবে না।

তিনি বলেন, আইনটি সময়োপযোগী করে করা হয়েছে। তারপরও কার্যকর করতে গিয়ে কোনো বিচ্যুতি নজরে এলে তা বিবেচনায় নেওয়া হবে।

অপরদিকে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরা আইসিআরআরএসকে সাধুবাদ জানাই। তবে এটি যেন বিনিয়োগের পথে কোনো ধরনের বাধা না হয়। এ ছাড়া এত বড় একটি নীতিমালা করা হয়েছে, সেখানে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি রাখা উচিত ছিল। কারণ আমরাই ঋণ নিয়ে ব্যবহার করি। সুতরাং ব্যবসায়িক বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতাগুলো আমাদের থেকে ভালো কেউ জানেন না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আগামী পাঁচ বছরে বেসরকারি বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৭ শতাংশে নিয়ে যেতে চায়। আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলেছে, তারা ভিশন ২০২১-২০৪১ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। নতুন সরকারের শেষ মেয়াদে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ২ হাজার ৭৫০ ডলার। বাজেটের আকার দাঁড়াবে ১০ লাখ কোটি টাকা, যা সর্বশেষ বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলার করবে এই সরকার। আর জিডিপির ৩৭ শতাংশ হবে বিনিয়োগ হার। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিনিয়োগ তথা অর্থনীতিকে আরো গতিশীল করতে হবে। বেসরকারি খাতকে অর্থনীতির চালকের আসনে বসাতে হবে।

বিদ্যমান নীতিমালায় বলা হয়, রেটিং করার ক্ষেত্রে গ্রাহকের পরিমাণগত সক্ষমতায় ৬০ শতাংশ নম্বর এবং গুণগত সক্ষমতায় ৪০ শতাংশ নম্বর রয়েছে। পরিমাণগত সক্ষমতা সূচকে ৬০ নম্বরের মধ্যে মোট গৃহীত ঋণ ও আর্থিক সক্ষমতায় ১০, চলতি দায় ও তরল সম্পদে ১০, মুনাফার সক্ষমতায় ১০, সুদ পরিশোধের সক্ষমতা ও নগদ প্রবাহের ওপর ১৫, পরিচালনগত দক্ষতায় ১০ এবং ব্যবসার মানের ওপর পাঁচ নম্বর। এ ছাড়া গুণগত সক্ষমতায় ৪০ নম্বরের মধ্যে কার্যদক্ষতার আচরণে (পারফরম্যান্স বিহ্যাভিয়ার) ১০, ব্যবসা ও খাত ঝুঁকিতে ৭, ব্যবস্থাপনা ঝুঁকিতে ৭, জামানত ঝুঁকিতে ১১, সম্পর্ক ঝুঁকিতে ৩, পরিপালন ঝুঁকিতে ২ নম্বর। এই রেটিংয়ে কোনো গ্রাহক ৮০-র বেশি নম্বর পেলে তাকে ‘চমৎকার’, ৭০-এর বেশি এবং ৮০-র কম নম্বর পেলে ‘ভালো’, ৬০-এর বেশি এবং ৭০-এর কম পেলে ‘ প্রান্তিক’ এবং ৬০-এর নিচে নম্বর পেলে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিং দেওয়া হচ্ছে। তবে কোনো গ্রাহক গুণগত রেটিংয়ে যত নম্বরই পাক না কেন, পরিমাণগত রেটিংয়ে ৫০ শতাংশ নম্বর না পেলে তাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিং দেওয়া হচ্ছে। ফলে তিনি আর ঋণ পাচ্ছেন না।

নীতিমালা অনুযায়ী কিছু খাত-উপখাত নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শিল্প খাতের মধ্যে তৈরি পোশাক, বস্ত্র, খাদ্যপণ্য, ওষুধ, রাসায়নিক, সার, সিমেন্ট, সিরামিক, জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙা, পাটকল, ইস্পাত ও প্রকৌশল, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads