• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বাড়তি ঋণও যাচ্ছে খেলাপিদের পেটে 

সংগৃহীত ছবি

ব্যাংক

বাড়তি ঋণও যাচ্ছে খেলাপিদের পেটে 

তিন মাসে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৭ হাজার কোটি

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯

অর্থনীতিতে মন্দা ভাব। বিনিয়োগ একটি স্তরে আটকে আছে। বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমেছে তলানিতে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করছে। সেটিও গিলে খাচ্ছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু একই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের ৬০ শতাংশই যাচ্ছে খেলাপিদের পেটে। অবশ্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হারকে খেলাপি ঋণ বাড়ানোর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে ঋণের অর্থ পরিশোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যদিও ব্যাংকারদের দাবি, খেলাপি ঋণের কারণে ঋণের সুদ হার বেড়ে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবমতে, দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

এর সঙ্গে অবলোপন করা ঋণ যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়াবে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের হার ও পরিমাণ দুটিই বেড়েছে চলতি বছরের জুন থেকে। চলতি বছরের জুনে ছিল এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি ২২ লাখ টাকা। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাত হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, খেলাপি ঋণ কমাতে বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সরল সুদে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অনেক গ্রাহক এর আওতায় এরই মধ্যে আবেদন করেছেন। আবেদনের আওতায় আসা ঋণগুলো পুনঃতফসিল করার প্রক্রিয়া চলছে।

গত জুনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১৩৫ কোটি টাকা কমে ৫৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকায় নেমেছে। সেটি সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার ২২২ কোটি টাকা। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের জুন শেষে খেলাপি ছিল চার হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ।

বিদেশি ব্যাংকগুলোতে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের হিসাব দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯১ কোটি টাকা। মোট ঋণের ৬ দশমিক শূন্য এক শতাংশ খেলাপি। বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো একই সময়ে ঋণ বিতরণ করেছে ৩৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে তাদের মোট বিতরণ করা ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৫৪ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা খেলাপি। অর্থাৎ মোট ঋণের ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ খেলাপি। চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ-এবিবির চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা ছাড়া আমাদের তহবিল ব্যয় অনেক বেশি। ফলে সুদ হার কমানো যাচ্ছে না। 

চলতি অর্থবছরের অক্টোবর শেষে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ হয়েছে, যা আগের মাস সেপ্টেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোকে বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ফলে ব্যাংকে এখন পর্যাপ্ত নগদ অর্থ নেই। বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এর অন্যতম কারণ।

চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করেছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। যা গেল অর্থবছরের জুন পর্যন্ত লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ঋণের উচ্চ সুদহারসহ বিভিন্ন কারণে অনেক উদ্যোক্তা ঝুঁকি নিয়ে ঋণ নিতে চাচ্ছে না। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ কমে গেছে। তিনি আরো বলেন, প্রবৃদ্ধির জন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। তাই এজন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, সেপ্টেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর আগের মাস জুলাই শেষে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, মে মাসে যা ছিলো ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর আগের মাস এপ্রিলে ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায়। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ১ জুলাই থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সরকার ঋণ নিয়েছে ৩৮ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র চার মাসেই সরকার পুরো অর্থবছরের ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ নিয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads