• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
৪৫ হাজার কোটি টাকার মন্দঋণে বিশেষ সুবিধা

ছবি : সংগৃহীত

ব্যাংক

ব্যাংক খাতে বাড়ছে হতাশা

৪৫ হাজার কোটি টাকার মন্দঋণে বিশেষ সুবিধা

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯

অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত ব্যাংক খাত। বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সচল রাখতে ব্যাংক খাতের গুরুত্ব অনেক। অন্যদিকে আমাদের দেশে এখনো বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি হতাশা তৈরি করছে। খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি, আমানত ও ঋণের উচ্চ সুদহারসহ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সব সূচক নিম্নমুখী হওয়ায় ব্যাংক খাতে হতাশা বাড়ছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বার বার আশার কথা শোনালেও অবনতি ঠেকানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ৪৫ হাজার কোটি টাকার মন্দঋণ বিশেষ সুবিধায় নিয়মিত করার কার্যক্রম চলছে।

সূত্র জানায়, এরই মধ্যে আগের ঘোষণা কার্যকর করতে নতুন করে চেষ্টা করছেন ব্যাংক মালিকরা। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো হু-হু করে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। নানা পদক্ষেপ গ্রহণ ও খেলাপিদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও আসছে না কোনো ইতিবাচক ফল। উল্টো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে খেলাপির পরিমাণ। এই মুহূর্তে ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১২ শতাংশই খেলাপি। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যমান পরিস্থিতি ব্যাংকিং খাতের জন্য ‘অশনিসংকেত’- এমন মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ায় ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ সমস্যার সমাধানে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বাড়ছে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে যত নীতি সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তার পুরোটাই খেলাপিদের পক্ষে, এখানে ভালো গ্রাহকদের জন্য কিছুই নেই। মূলত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব নয়। তার আগে নতুন খেলাপি বন্ধ করতে হবে। সেজন্য খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দীর্ঘ করা যাবে না।

তাই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে অনেক আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। আইনগুলোকে কার্যকর করতে হবে। এ সবকিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা সদিচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়। সর্বোপরি ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। তা না হলে বারবার একই দৃশ্যের অবতারণা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। তিন মাস আগে ঋণ ছিল ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। আর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৯ লাখ ১১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৭ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বরের তুলনায় বেড়েছে ৫৮ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। ঋণ প্রবৃদ্ধিতে এভাবে ধীরগতি থাকলেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে ঠিকই লাগামহীনভাবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার দুটি প্রক্রিয়ায় খেলাপিদের উৎসাহ দিয়েছে। প্রথমত খেলাপি হওয়ার সময়সীমা বাড়ানো; দ্বিতীয়ত দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ। যেখানে সুদহার মাত্র ৯ শতাংশ। এসব কারণে নিয়মিত যারা টাকা পরিশোধ করতেন, তারা দেখছেন টাকা না দিলেই লাভ বেশি। ফলে কিস্তি না দিয়ে তারাও খেলাপি হয়েছেন। ফলে খেলাপি ঋণ না কমে বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী গত ১৬ মে ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি হওয়া ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট বা এককালীন জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই পুনঃতফসিল পাওয়া প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সুদ নিতে পারবে ৯ শতাংশ। ব্যাংক চাইলে পুনঃতফসিলের আগে সুদ মওকুফ সুবিধা দিতে পারবে। ঋণখেলাপিদের জন্য এতসব সুবিধা দিয়ে গত মে মাসে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরকম নীতিমালার সমালোচনা করে আসছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত এক সেমিনারে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি’র আবাসিক প্রতিনিধি বলেন, এভাবে ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানো আন্তর্জাতিক চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে বিশেষ নীতিমালার আওতায় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদন এসেছে পাঁচ হাজার ৪৬৩টি। এসব আবেদনের বিপরীতে ৪৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল চেয়েছেন খেলাপিরা। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮০৩টি আবেদন নিষ্পত্তি করেছে ব্যাংকগুলো। যার বিপরীতে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ১৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। এর বাইরেও অনেক ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। গত সাড়ে ছয় বছরে ১ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে ব্যাংকগুলো। আবার চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ৪০ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ঋণ পুনর্গঠনের ১৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের অঙ্ক দাঁড়াবে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। যদিও এর মধ্যে কিছু অংশ আদায় হয়েছে। ঋণখেলাপি, ঋণ অবলোপন, ঋণ পুনঃতফসিল এবং ঋণ পুনর্গঠনকে একসঙ্গে ‘স্ট্রেসড অ্যাসেট বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ’ বলে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে নিট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৮ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩টি ব্যাংকের মোট ৯ হাজার ৪৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকার প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি, যা সরকারি ৩টি ব্যাংকের ৬ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, বেসরকারি খাতের ৯টি ব্যাংকের ২ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা এবং একটি বিদেশি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকে ১৫৬ কোটি টাকা রয়েছে। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংক খাতে ৩০২ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে ঝুঁকি।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৬২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে সেপ্টেম্বর শেষে ৫৪ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা প্রভিশন রেখেছে ব্যাংকগুলো। এতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৮ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। তবে জুন মাসের তুলনায় ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি কমেছে সেপ্টেম্বরে। চলতি বছরের জুন শেষে মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার এক ২১৯ কোটি টাকা।

জানা গেছে, ঋণ শ্রেণিকরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। তা হলো নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ বা ক্ষতি। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণ নিম্নমান হলে তার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ২০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর পরপর ছয় মাস ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সে ঋণকে সন্দেহজনক ঋণ বলা হয়। আর এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ৫০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর ৯ মাস অতিবাহিত হলে ওইসব ঋণকে মন্দঋণ বলা হয়। এই মন্দঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংকের আয় খাত থেকে বেশি পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করলে ওই ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads