• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ব্যাংক

সুদ মওকুফের মচ্ছব

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ২০ জানুয়ারি ২০২০

ঋণখেলাপিদের সুদ মওকুফের মচ্ছব চলছে। এরই মধ্যে ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা মওকুফ করে নিয়েছেন তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধার আওতায় এই অর্থ মওকুফ পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় অঙ্কের সুদ মওকুফ অর্থনীতিতে ভালো কিছু আনবে না। এটি দুষ্টদের প্রশ্রয় দেওয়ার নীতির বাস্তবায়ন, শাস্তি একেবারে অনুপস্থিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বিশেষ সুবিধায় পুরনো ঋণ পুনঃতফসিলে সুদ মওকুফ করা হয়েছে ৫ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। আর এককালীন এক্সিট হিসেবে ঋণখেলাপিদের এক হাজার ১৯৩ কোটি টাকা মওকুফ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ ডিসেম্বরভিত্তিক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। যাতে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা ঘোষণার পর এ সংক্রান্ত সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এর আওতায় মোট আবেদন এসেছে ১৩ হাজার ৩৬৮টি। ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন এসেছে ৮ হাজার ৫৪৬টি, আর এককালীন এক্সিটের জন্য আবেদন এসেছে ৪ হাজার ৮২২টি। এর দুই ক্যাটাগরিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৬ হাজার ৬৩২টি আবেদন নিষ্পত্তি করেছে।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এটি দুষ্ট নীতির বাস্তবায়ন। এর ফলে ঋণগ্রহীতার আচরণে এক ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। ঋণখেলাপিদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আবার ভালো ঋণকে খারাপ দেখিয়ে সহায়তা নেওয়ারও একটি মনোভাব তৈরি হয়েছে। এটি এক অঙ্ক সুদ বাস্তবায়নে বাধা হবে। কারণ এই ধরনের পলিসি বাস্তবায়ন ঋণ গ্রহীতাকে খারাপ দিকে নিয়ে যাবে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এই নীতির কারণে কিছু হয়তো আদায় হয়েছে। তবে বড় অঙ্কের অর্থ ঝুঁকিতে চলে গেল। এর ফলে ব্যাংকের স্বাস্থ্য সাময়িক ভালো দেখাবে, খেলাপি ঋণ কমবে। কিন্তু কার্যত, ব্যাংকের আর্থিক ভিতকে আরো দুর্বল করছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই মুখ্য অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বিশেষ এই নীতির বাস্তবায়নে ঋণখেলাপির আচরণের পরিবর্তন না আসলে এক অঙ্ক সুদে ঋণ কার্যকর করা বড় বাধা। খেলাপিদের জন্য কড়া কোনো ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু সেদিকে কোনো পদক্ষেপ দেখি না। যদিও বলা হয়েছিল শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঋণখেলাপিদের সব ধরনের নীতি সহায়তা ও সামাজিক সুবিধা বন্ধ করা গেলে একটি বার্তা যেত। তখন এই বিশেষ পলিসির কিছুটা সঠিক ব্যবহার হতো।

জানা গেছে, সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। তিন মাস আগে ঋণ ছিল ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা।

দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে। যেখানে সুদহার মাত্র ৯ শতাংশ। গত ১৬ মে ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রজ্ঞাপনের পক্ষে আদালতের সিদ্ধান্ত পায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মোতাবেক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্তের পর যেসব ঋণে ছাড় দেওয়া হয়েছে তার মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ১৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। আর এককালীন এক্সিট হিসেবে নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৯২৮ কোটি টাকা।

ঋণ খেলাপিদের সুদ মওকুফ করা হয়েছে দুই শ্রেণিতে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, স্থগিত সুদ হিসেবে মওকুফ। এতে ব্যাংকগুলো মোট ২ হাজার ৭ কোটি টাকা মওকুফ করেছে। পুনঃতফসিল করতে মওকুফ করা হয়েছে এক হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। আর এককালীন এক্সিটে গেছে ২১৬ কোটি টাকা। অনারোপিত সুদ খাতে ব্যাংকগুলো মোট মওকুফ করেছে ৫ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে এককালীন এক্সিটে গেছে ৯৭৬ কোটি টাকা। আর পুনঃতফসিলে গেছে ৪ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা।

জানা গেছে, ডাউনপেমেন্ট আদায় হয়েছে ৪৪০ কোটি টাকা। মোট আবেদনের হিসাবকৃত স্থিতি ২৩ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা।

জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে নিট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৮ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩টি ব্যাংকের মোট ৯ হাজার ৪৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকার প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। যা সরকারি ৩টি ব্যাংকের ৬ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, বেসরকারি খাতের ৯টি ব্যাংকের ২ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা ও একটি বিদেশী খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকে ১৫৬ কোটি টাকা রয়েছে। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংক খাতে ৩০২ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে ঝুঁকি। ৬২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে সেপ্টেম্বর শেষে ৫৪ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা প্রভিশন রেখেছে ব্যাংকগুলো। এতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৮ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। তবে জুন মাসের তুলনায় ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি কমেছে সেপ্টেম্বরে। চলতি বছরের জুন শেষে মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার এক ২১৯ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads