• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

ব্যাংক

ব্রিকস ব্যাংকে সাড়া দেওয়া বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৫ ডিসেম্বর ২০২০

ব্রিকস ব্যাংক বা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (এনডিবি) বাংলাদেশের সাড়া দেওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

২০১৪ সালে এনডিবি গঠনের সময়ই বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার আলোচনা ওঠে। তখন চীনের উদ্যোগে প্রস্তাবিত এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকে (এআইআইবি) যোগদানকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল সরকার।

তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ব্রিকস ব্যাংকের গতি খুবই স্লো (ধীর)। আমরা (সরকার) এটা নিয়ে এই মুহূর্তে খুব একটা ভাবছি না। যখন এটার গতি পাবে তখন আমরা ওটা নিয়ে ভাবব। তার ছয় বছর পর ব্রিকস ব্যাংকে যোগ দেওয়ার পক্ষে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার; যখন ব্যাংকটি তাদের মোট মূলধন জড়ো করেছে ১০০ বিলিয়ন ডলার, তাদের প্রাথমিক মূলধন ৫০ বিলিয়ন ডলার।

বর্তমান অবস্থায় ব্রিকস ব্যাংকে বাংলাদেশের যোগদানে সাড়া দেওয়াকে ইতিবাচক মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, বহুজাতিক এই ব্যাংক থেকে অবকাঠামো ঋণ পাওয়ার সুবিধাই হবে; যদিও ঋণের শর্তের দিক এবং ব্যাংকের পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্য বহুজাতিক ব্যাংকের সঙ্গে এর তেমন পার্থক্য সেভাবে নেই। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই পাঁচ দেশের অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসের উদ্যোগে ২০১৫ সালের ২১ জুলাই যাত্রা শুরু করে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এনডিবি।

গত ১৭ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এনডিবির সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানান ব্রিকসের সদস্য রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছেন বলে সেদিনই জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী।

পরিসর বিস্তৃত করার জন্য এরই মধ্যে সদস্য পদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে এনডিবি কর্তৃপক্ষ, চূড়ান্ত করা হয়েছে সদস্যপদ দেওয়ার নীতিমালাও। জাতিসংঘের যে-কোনো সদস্য দেশ এনডিবির সদস্য হতে পারবে- এমন নীতিতেই এগোচ্ছে এনডিবি। তবে প্রাথমিকভাবে প্রত্যেক সদস্য দেশকে দুটি করে সদস্য দেশ মনোনয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ভারতের ইকোনমিক টাইমস।

গত ১৭ নভেম্বর ব্রিকসের ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনের যৌথ বিবৃতিতেও সদস্যপদ বাড়ানোর নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে।

সেখানে ব্রিকস নেতারা বলেন, এনডিবির বোর্ড অব গভর্নরসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাংকের সদস্যপদ বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে তারা সমর্থন করেন। এটি বৈশ্বিক উন্নয়নমূলক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনডিবির ভূমিকাকে শক্তিশালী করবে এবং সদস্য দেশের অবকাঠামো ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অর্থের জোগানে ভূমিকা রাখবে। সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে এবং ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্বের বিবেচনায় সদস্যপদ ভারসাম্যমূলক হওয়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ ক্রেডিট রেটিং প্রাপ্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এনডিবির লক্ষ্যের আলোকে হতে হবে। এসব নীতির আলোকে সদস্যপদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার সূচনাকে এবং এনডিবির সদস্যপদ বাড়ানোর কার্যক্রমকে আমরা স্বাগত জানাই।

২০১৭ সালে দ্বিতীয় বার্ষিক সভায় সদস্যপদের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে, এমন দেশের একটি তালিকাও করেছিল এনডিবির বোর্ড অব গভর্নরস। সদস্য পদের টার্মস অব রেফারেন্স অনুযায়ী, নতুন সদস্য দেশ একজন গভর্নর এবং একজন বিকল্প গভর্নর নিয়োগ দেবে। একই সঙ্গে পরিচালক ও তাদের বিকল্প নির্বাচন করবে; তবে পরিচালকের সংখ্যা কোনোভাবে ১০ জনের বেশি হবে না।

নভেম্বরে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে গত পাঁচ বছরে এনডিবির কার্যক্রমের নানা দিক ব্রিকস নেতাদের কাছে তুলে ধরেন এনডিবি চেয়ারম্যান মার্কোজ ত্রোইহো।

তিনি বলেন, আমাদের সমকক্ষ প্রতিষ্ঠান কয়েক দশকে যা করেছে, আমরা মাত্র পাঁচ বছরে তার চেয়ে বেশি অর্জন করেছি।

আমরা ইতোমধ্যে ৬৫টি প্রকল্প গ্রহণ করেছি, যার মোট পরিমাণ ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রত্যাশা করছি, বছরের শেষ নাগাদ আমাদের প্রকল্প অনুমোদনের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।

ইতোমধ্যে ফিচ ও স্টান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স থেকে ‘ডাবল এ প্লাস’ রেটিংয়ের পাশাপাশি জাপান ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ও অ্যানালিটিক্যাল ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি থেকে ‘ট্রিপল এ’ রেটিং অর্জন করেছে এনডিবি।

এসব রেটিং প্রতিযোগিতামূলক হারে তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে এনডিবিকে সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে বলে মত দিচ্ছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ব্রিকস ব্যাংকে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি লাভ দেখছেন।

তিনি বলেন, একটা হলো আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রকাশ। দ্বিতীয়ত, এটার রুল মেকিংয়ের সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত থাকতে পারব। তৃতীয়ত, ঋণ ইত্যাদির পাওয়ার ক্ষেত্রেও আমাদের একটি সুবিধা হবে এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে। আমি এটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখি।

অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে সরকার ১৫ বছরের জন্য প্রায় এক হাজার বিলিয়ন ডলারের বাজেট করেছে। যাতে প্রতি বছর খরচ জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ অন্যরা এক্ষেত্রে অর্থায়ন করেছে।

এগুলোর সবাইকে একত্রিত করলেও এটার কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে না। সেজন্য নতুন অর্থায়নের জায়গার প্রয়োজন আছে। দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন করবে। পজিটিভ দিক হচ্ছে, এ রকম একটা নতুন জানালার প্রয়োজন আছে। জায়গা আছে এদের সঙ্গে কাজ করার।

রেটিংয়ের প্রসঙ্গ টেনে মোস্তাফিজুর বলেন, তাদের রেটিং দেখলাম ‘ডাবল এ প্লাস’ এবং এটার সাথে এআইআইবিরও একটা ভালো সম্পর্ক আছে। সেদিক থেকে অবকাঠামো প্রভৃতির ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা সুবিধা আমাদের হবে।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশের বাস এনডিবির সদস্যভুক্ত দেশে এবং মোট বৈশ্বিক জিডিপির ২০ শতাংশের বেশিতে অবদান এই দেশগুলোর।

এ কারণে প্রতিষ্ঠার সময় বলা হয়েছিল, উদীয়মান অর্থনীতির এসব দেশে অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এনডিবি।

তাদের সঙ্গে ব্রিকস ব্যাংকের পার্থক্য সম্পর্কে এক প্রশ্নে মোস্তাফিজুর বলেন, মোটা দাগে তেমন পার্থক্য নাই। প্রথম দিকে অনেকে মনে করছিল, এটা হয়তো ওভারসাইট, রুলস ইত্যাদির দিক থেকে বেশ স্টিনজেন্ট হবে। এটা বেশি করে অবকাঠামোগত ও উন্নয়নশীল দেশকেন্দ্রিক, ওদিক থেকে খুব বড় পার্থক্য দেখি না। তবে অন্যদিক থেকে এখানে আমেরিকা-ইউরোপের খবরদারি নাই। এটা বেশি করে উন্নয়নমূলক ও অবকাঠামোমুখী থাকবে। এটার মনোভাব উন্নয়নশীল দেশমুখী থাকবে। সে হিসাবে আমার মনে হয় রাজনৈতিক অর্থনীতি সঠিক পথে আছে।

বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সঙ্গে ব্রিকস ব্যাংকের তেমন কোনো পার্থক্য না থাকার কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও।

তিনি বলেন, শুরুতে ওরা বলেছিল, যেহেতু আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের পরিচালনার ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশের তেমন কোনো গুরুত্ব নাই, এগুলো ইউরোপ-আমেরিকা একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, গভর্নিং বোর্ডে উন্নয়নশীল দেশের তেমন ভয়েস নাই। সেজন্য আমরা একটা বিকল্প ব্যাংক গড়ছি, যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো এটাতে নেতৃত্ব দেবে এবং তাদের প্রয়োজনগুলো প্রপারলি অ্যাড্রেস করা হবে। কিন্তু তারা যে গভর্ন্যান্স স্ট্রাকচারটা করেছেন, এখানে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠাতা পাঁচটা দেশই ডমিনেট করবে। এবং বলছে, শেয়ার হোল্ডিং ৫৫ শতাংশের নিচে নামতে পারবে না। কাজেই ওখানে তারা যে গভর্ন্যান্স স্ট্রাকচারটা তৈরি করেছে, এটা একেবারে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফকে কাট অ্যান্ড পেস্টের মতোই। একই মডেল।

আমন্ত্রণ ও সাড়াদানের পর সদস্য পদের প্রক্রিয়া শুরুর জন্য এখন আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন ভারতের হাইকমিশনার দোরাইস্বামী।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বাংলাদেশকে ব্যাংকের অংশীদার হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তার মানে হচ্ছে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া এবং সে বিষয়ে মত দেওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্পে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা হওয়ার কথা তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ১০০ বিলিয়ন ডলারের ব্যাংক। ভারত সরকার আমাদেরকে এতে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। আমরা রাজি আছি, এটাতে জয়েন করব। আমাদের দেশে বহু রকমের প্রজেক্ট হচ্ছে, মেগা প্রজেক্ট হচ্ছে, আমাদের টাকা-পয়সা আরো বেশি দরকার।

বাংলাদেশের জন্য এনডিবির সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া এখনো পরিষ্কার না থাকার কথা উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ১০০ বিলিয়ন ডলারের মোট ১০ লাখ শেয়ারের ৫ লাখ তারা কিনে নিয়েছে। একেকটা শেয়ারের দাম এক লাখ ডলার। এখন প্রশ্ন হলো, আমাকে সদস্য হতে হলে আমার কতগুলো শেয়ার দরকার। আবার এটাও বলা আছে, প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের বাইরে ৭ শতাংশের বেশি শেয়ারহোল্ডার কেউ হতে পারবে না। তার মানে আপনি ৭০টার বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবেন না। তবে কেউ একটা শেয়ার নিলেই কি সদস্য হয়ে যাবে? সেটাও কিন্তু এখনো পরিষ্কার না।

সুদের হার সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা যেটা বলেছে, এটার সুদের হারটা কিন্তু ফিক্সড না। এটা প্রতি ছয় মাস অন্তর বদলাতে থাকবে। যখনই সুদ ওরা নেবে, ডলার ভিত্তিতে ঋণ নিলে ডলার লাইবর এবং ইউরো হলে ইউরো লাইবরের ভিত্তিতে হবে। আর ওগুলা তো ওঠানামা করতে থাকে। ফ্লোটিং রেট যেহেতু, সেহেতু ওঠানামা করবে। এর বাইরে ওরা কিছু স্প্রেড চার্জ করে। স্প্রেডটা আমি যেটা দেখলাম, তাতে মনে হয়েছে আরো অন্তত ১ শতাংশ অ্যাড করবে। সঙ্গে এদের কিছু কমিটমেন্ট ফি আছে, আবার কিছু দেশকেন্দ্রিক রিস্ক প্রিমিয়ামও চার্জ করবে।

ডলার-ইউরোর বাইরে স্থানীয় মুদ্রায়ও বিনিয়োগ শুরু করেছে এনডিবি। সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ সেভাবে না থাকায় এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, শুধু লোকাল কারেন্সিতেও ওরা অর্থায়ন করবে। যাতে এক্সচেঞ্জ রেটটা গ্রহীতার ওপর না হয়ে ক্রেডিটরের ওপরও চলে যাবে। এখন আমরা ডলারে নিলে এক্সচেঞ্জ রেট বেড়ে গেলে আমাদের বাজেটের সময় বরাদ্দ আরো বাড়াতে হয়। সুদ-আসল দুটোর জন্য।

সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা বলেছে যে, লোকাল কারেন্সিতেও ঋণ নেওয়া যাবে। লোকাল কারেন্সিতে ঋণ দিতে গেলে ওরা মার্কেটে বন্ড ইস্যু করবে। সেখান থেকে টাকাটা উঠিয়ে টাকাটা দেওয়া হবে। ওই বন্ডের রিস্কটা তারা নিচ্ছে, আপনি টাকাটা পাচ্ছেন লোকাল কারেন্সিতে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads