• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ছবি: সংগৃহীত

জীব বিজ্ঞান

পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করে শৈবাল

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২৩ এপ্রিল ২০১৮

আর্সেনিক একটি বিষাক্ত খনিজ মৌলিক পদার্থ। এর কোনো স্বাদ বা গন্ধ নেই। পারমাণবিক সংখ্যা ৩৩ এবং পারমাণবিক ভর ৭৪.৯। অর্ধপরিবাহী ও সঙ্কর ধাতু তৈরিতে আর্সেনিক ব্যবহূত হয়। এটি মৌলিক পদার্থ হিসেবে থাকলে পানিতে দ্রবীভূত হয় না এবং বিষাক্তও হয় না। কিন্তু বাতাসে জারিত হয়ে অক্সাইড গঠন করলে এটি বিষাক্ত হয়ে ওঠে।

উৎস

মানুষের দেহে, মাটিতে এবং সমুদ্রের পানিতে সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক লক্ষ করা যায়। মাটির উপরিভাগের চেয়ে অভ্যন্তরে আর্সেনিক বেশি পরিমাণে থাকে। মাটির নিচে পাথরের একটি স্তর আছে যাতে পাইরাইটস নামে একটি যৌগ আছে। এই যৌগে আর্সেনিক বিদ্যমান। তবে সবচেয়ে বেশি আর্সেনিক দেখা যায় শিলাখণ্ডের ভূ-ত্বকে। আর্সেনিক সালফাইড, অক্সাইড ও আর্সেনাইড আর্সেনিকের প্রধান উৎস বলে বিবেচিত। আমাদের দেশে আর্সেনিকের মূল উৎস হলো নলকূপের পানি।

আর্সেনিক কেন সমস্যা

পানিতে আর্সেনিক বিষ থাকলেও তা খালি চোখে দেখা যায় না। এ কারণে না জেনেই অনেক সময় আর্সেনিক বিষ রয়েছে এমন নলকূপের পানি পান করা হয়। পানি বা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি পরিমাণে আর্সেনিক শরীরে প্রবেশ করলে ধীরে ধীরে দেহে তা জমা হতে থাকে এবং মানুষের দেহে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া দেখা দেয়। মানুষের দেহে সাধারণত আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার লক্ষণ ৬ মাস থেকে ২০ বছর অথবা এর চেয়েও বেশি বছর পর দেখা যায়। এটি নির্ভর করে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর।

আর্সেনিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবীর সকল মহাদেশের ৫০টির মতো দেশে ভূগর্ভস্থ বা ভূ-উপরিস্থ পানিতে উচ্চমাত্রার আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়েছে। তাইওয়ানে প্রথম শনাক্তকরণের পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রমান্বয়ে আর্সেনিক দূষণ শনাক্ত করা হয়েছে। আর্জেন্টিনা, চিলি,  মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তানে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা অনেক বেশি।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশে বিভিন্ন মাত্রার আর্সেনিক দূষণ রয়েছে।

তবে আক্রান্ত বা ঝুঁকিগ্রস্ত জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সর্বাধিক দূষণগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। মাটির নিচে বিশেষ স্তরে আর্সেনিক সঞ্চিত থাকে এবং নলকূপের পানির মাধ্যমে তা উত্তোলিত হয়। বিগত কয়েক দশক যাবৎ কৃষি উৎপাদনে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে, ফলে তা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে দূষিত করছে নদী-নালা, খাল-বিল এবং সমুদ্রের পানি। এই অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার আর্সেনিক দূষণের একটি অন্যতম কারণ। মাটির বিশেষ যে স্তরে আর্সনোপাইরাইট নামক পদার্থ আছে, ভূ-গর্ভস্থ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে তা পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। প্রতিদিন কৃষিকাজ থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহারের জন্য আমরা যে কোটি কোটি লিটার পানি উত্তোলন করি, তাতে ভূগর্ভে যে সাময়িক শূন্যতার সৃষ্টি হয় এতে বায়ু এবং অক্সিজেন মিশ্রিত পানির সঙ্গে আর্সেনিক মিশে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে আর্সেনিক দূষণ।

আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা

প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা ০.০৫ মিলিগ্রাম। ০.০৫ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে সে পানি পান করা ও রান্নার কাজে ব্যবহার করা যাবে না। এজন্য আর্সেনিক দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু উপায়ও ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে।

দূষণমুক্তির পদ্ধতি

বালতি পদ্ধতি, তিন কলসি পদ্ধতি এবং পিএসএফ পদ্ধতিসহ বৃষ্টির পানি সংগ্রহ পদ্ধতি আমাদের দেশে ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। তবে জার্মানির বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সম্প্রতি তারা প্রকৃতিতে পাওয়া উপাদান থেকেই পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করার উপায় আবিষ্কার করেছেন।

বিজ্ঞানীরা পানি থেকে আর্সেনিক দূর করার মাধ্যমে পরিশোধনে সক্ষম এক প্রজাতির মস আবিষ্কার করেছেন। এর মাধ্যমে আর্সেনিক দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ তৈরি করা যাবে বলে তারা আশা  করেন।

Warnstofia fuitans নামের এই মস প্রজাতি সুইডেনের স্থানীয় জলজ মস। এখানকারই স্টোকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই মস ব্যবহার করে পানি থেকে ৮২ শতাংশ আর্সেনিক দূর করতে সক্ষম হয়েছেন।

এই পদ্ধতির নাম ফাইটোফিল্ট্রেশন, যা উদ্ভিদের পানি থেকে ভারী মৌল দূরীকরণের এক ধরনের সক্ষমতা। গবেষণা সহকারী আরিফিন সন্ধি এই প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে পানি থেকে আর্সেনিক দূরীকরণে মসের উচ্চ ধারণক্ষমতা রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় আর্সেনিক দূরীকরণে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। এটুকু সময় পানি হয়ে আর্সেনাইট এবং আর্সেনেট দূর করে এর ক্ষতিকর প্রভাব নিষ্ক্রিয় করার জন্য যথেষ্ট।

গবেষক দলটি এই পদ্ধতিকে ‘পরিবেশবান্ধব আর্সেনিক দূরীকরণ পদ্ধতি’ বলছেন এবং উল্লেখ করছেন এই মস যেকোনো পানির প্রবাহে জন্মানো সম্ভব, যা ওই পানি থেকে আর্সেনিক শুষে নেবে।

Environmental Pollution জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার গবেষকরা একটি ‘উদ্ভিদ-নির্ভর জলাভূমি’ তৈরির চেষ্টা করছেন যেখানে পানির মধ্যে মসের চাষাবাদ করে পানিকে অর্সেনিকমুক্ত রাখা হবে। এ ছাড়া সেচ প্রকল্পেও মস প্রয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে যেখানে শস্য উৎপাদনের আগেই মসের মাধ্যমে আর্সেনিক দূর হবে এবং শস্যের মধ্যে আর্সেনিক পৌঁছাতে পারবে না।

তবে আর্সেনিকের অভিশাপ থেকে বাঁচতে নলকূপ বসানোর আগে মাটির নিচের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখতে হবে, টিউবওয়েল বসানোর পর গোড়া বাঁধানোর আগে আর্সেনিক পরীক্ষা করাতে হবে, টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেলে টিউবওয়েলের মুখ লাল রঙ করতে হবে। পানিতে আর্সেনিক না থাকলে সবুজ রঙ করতে হবে। আর্সেনিক দূষণমুক্ত টিউবওয়েলের পানি প্রতি ৬ মাস পর পর পরীক্ষা করাতে হবে। দেখতে হবে পানি আর্সেনিক দূষণমুক্ত আছে কি না। পুকুর বা নদীর পানি বিশুদ্ধ করে পান করতে হবে। বৃষ্টির পানি আর্সেনিকমুক্ত। তাই বৃষ্টি শুরু হওয়ার ৫ মিনিট পর পরিষ্কার পাত্রে ধরে সেই পানি খাওয়া ও রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়। তবে সতর্ক থাকতে হবে যেন আর্সেনিকযুক্ত পানি ফুটিয়ে না পান করা হয়। কারণ ফুটালে আর্সেনিক দূর হয় না বরং পানি শুকিয়ে গেলে তাতে আর্সেনিকের ঘনত্ব আরো বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads