• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
ভোটার তুষ্টির বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ রাজস্ব

নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে সাড়ে ৩১ শতাংশ

সংরক্ষিত ছবি

বাজেট

ভোটার তুষ্টির বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ রাজস্ব

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ০৬ জুন ২০১৮

চলতি অর্থবছর ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা মন্থর গতির কারণে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৫৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এ অবস্থায় আগামী বছরের বাজেটে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ধরা হচ্ছে। এ লক্ষ্য পূরণে ৮১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা বাড়তি সংগ্রহ করতে হবে। নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে সাড়ে ৩১ শতাংশ। চলতি বছরে ২৮ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা কাটছাঁট হলেও বছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ৫০ হাজার কোটি টাকায় উঠতে পারে। এ আশঙ্কা সত্যি হলে নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আদায় ৪০ শতাংশ বাড়াতে হবে বলে ধারণা দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। গত কয়েক বছর ধরে রাজস্বের প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের ঘরে সীমাবদ্ধ আছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় ৪০ শতাংশ বাড়তি আদায়ের লক্ষ্য পূরণ অসম্ভব বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের।

বছর শেষে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আগামী অর্থবছরের বিশাল বাজেটের অর্থ সঙ্কুলানে এমন অসম্ভব লক্ষ্যই নির্ধারণ করা হচ্ছে। ভোটার তুষ্টির জন্য বড় প্রকল্পগুলো দৃশ্যমান করতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার চাপ রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তি, সরকারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য রেয়াতি হারে আবাসন ঋণের সুদের দায় মেটানোসহ সব পক্ষকে খুশি রাখতে বাজেটে ব্যয় ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ ব্যয় ছিল ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। মূল বাজেটের তুলনায় নতুন বছরের বাজেটে ব্যয় বাড়ছে ৬৭ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ বাড়ছে ৯৬ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা।

এবারের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটে ২৬ শতাংশ বাড়তি ব্যয় করতে সম্ভাব্য আয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। ঘাটতি থাকছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ প্রায় চার গুণ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশি উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার নিয়ে এ ঘাটতি পূরণ করতে চায় সরকার। তবে কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরও প্রত্যাশিত হারে বিদেশি সহায়তা না আসলে ঘাটতি মেটানো কঠিন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। এমন পরিস্থিতি হলে ব্যাংক থেকে ধারণার চেয়ে বেশি ঋণ নিতে হবে। এতে তারল্য সঙ্কটে জর্জরিত ব্যাংক খাতে আরো চাপ বাড়বে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।

অর্থ বিভাগের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরেই বিশাল আকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে। অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা আর পূরণ হয় না। শেষ দিকে এসে তা সংশোধন করে কমিয়ে আনা হয়। গত চার বছর ধরে এটি এক রকম নিয়মেই পরিণত হয়েছে।

২০১৭-১৮ অর্থবছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় গত অর্থবছরের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। সাত মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায় বেড়েছে ১৫ শতাংশের কিছু কম। প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকায় পরে লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বরাবরই আদায়যোগ্য ও বাস্তবসম্মত রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ৩০ শতাংশের ওপরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো অবাস্তব। এটা অর্জন সম্ভব হবে না। তিনি আরো বলেন, এক বছরে রাজস্ব আদায় সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২২ শতাংশ বাড়তে পারে। নতুন বাজেটে বড় লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে বাহবা আদায় করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদে তা গুরুত্ব হারাবে বলেও মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

সরকারের রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে এনবিআর। সংস্থাটির রাজস্ব আদায় গত পাঁচ বছরে গড়ে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে গত তিন অর্থবছরে বেড়েছে ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ, আর সর্বশেষ গত অর্থবছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। অথচ পাঁচ বছর ধরেই রাজস্ব আহরণে ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে।

গত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেই বাজেটের প্রাক্কলনকে ‘উচ্চাভিলাষী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে নেওয়ার পক্ষে কিছু যুক্তিও তুলে ধরেছিলেন তিনি। গত আট বছরে রাজস্ব বোর্ডের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা মোটামুটিভাবে এ ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছি যে, রাজস্ব প্রদান হয়রানির বিষয় নয়- জাতীয় দায়িত্ব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাজেটের আকার বাড়ছে। বিদেশি সহায়তা বাড়িয়ে এসব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়। এ অবস্থায় প্রয়োজন ও বাস্তবতার আলোকে যৌক্তিক আকারের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংক থেকে বাড়তি ঋণ নেওয়া হলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বন্ধ হয়ে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

যেসব সুবিধা থকছে : রাজস্ব আদায়ের বিশাল লক্ষ্য পূরণে নতুন বছর বাড়তি কর আরোপ হবে না বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বাজেটে ব্যক্তিগত করের আয়সীমাও অপরিবর্তিত থাকবে। লিস্টেড ননলিস্টেড কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে করপোরেট করহারে ছাড় থাকছে। নতুন আরো এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে। এজন্য বাড়তি পাঁচশ’ থেকে সাড়ে পাঁচশ’ কোটি টাকার বরাদ্দ থাকছে। এবারের বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য দেওয়া হচ্ছে ৪৪০ কোটি টাকা।

নতুন বাজেটে ভর্তুকি পাওয়া পণ্যের তালিকায় যোগ হচ্ছে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন ঋণের সুদও পরিশোধ করা হবে সরকারের তহবিল থেকে। তা ছাড়া খাদ্য, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দাঁড়াবে ৩২ হাজার কোটি টাকায়। এক বছরে ভর্তুকি বাড়বে ১৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বেশি দামে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে কম দামে বিক্রি করায় এ খাতে ভর্তুকি দিতে হবে আড়াই থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা। সরকারি ১৪ লাখ কর্মচারীর জন্য গৃহঋণে সুদ হিসেবে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার নতুন ভর্তুকি যুক্ত করা হতে পারে বাজেটে।

২০১৮-১৯ অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হতে পারে। চলতি অর্থবছর দেওয়া হচ্ছে ৬ হাজার কোটি টাকা। এবার কৃষিতে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হলেও আগামী অর্থবছর দেওয়া হতে পারে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। রফতানিতে নগদ সহায়তার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে আরো কিছু নতুন পণ্য। আগামী অর্থবছরের জন্য খাদ্যে ভর্তুকির পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকাতেই অপরিবর্তিত থাকছে।

নতুন বাজেটে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও সুখবর থাকছে। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতার পাশাপাশি বৈশাখী ভাতা পাবেন। এর পরিমাণ দুই হাজার টাকা। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতা ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া তারা দুই ঈদে সমপরিমাণ দুটি বোনাস পান।

সামাজিক সুরক্ষার দিকেও নজর দেওয়া হচ্ছে আগামী বাজেটে। বর্তমানে ৬৮ লাখ গরিব মানুষ বয়স্ক, বিধবাসহ নানা ধরনের মাসিক ভাতা পান। নির্বাচন সামনে রেখে ভাতাভোগীর সংখ্যা ৭৮ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে। এ ছাড়া মাতৃত্বকালীন ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুগ্ধদানকারী গরিব কর্মজীবী মায়ের মাসিক ভাতা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হচ্ছে।

জনগণের করের টাকা দিয়ে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কড়া সমালোচনা হচ্ছে। তারপরও প্রতিবছর বাজেটে এ খাতে আলাদা বরাদ্দ রাখা হয়। আগামী বাজেটে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে।

দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় বেশকিছু পণ্যের কাঁচামালের শুল্কও কমানো হচ্ছে। বর্তমান ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন সংশোধন করে অনলাইনের আওতায় আনার প্রস্তাব থাকবে বাজেটে। ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে উন্নতমানের ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) ব্যবহার বাধ্যতামূলক হচ্ছে। বাড়ানো হতে পারে দেশে তৈরি কিছু পণ্যের ট্যারিফও।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads