• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
দুর্বল ভিত্তি, লক্ষ্য বিশাল

২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তথ্যচিত্র

চিত্রাঙ্কন : বাংলাদেশের খবর

বাজেট

দুর্বল ভিত্তি, লক্ষ্য বিশাল

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ০৮ জুন ২০১৮

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার প্রথম দফায় দায়িত্ব নেওয়ার সময় ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক  শূন্য ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে উন্নীত হচ্ছে। একই সময়ে জিডিপির আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ৩৮৫ কোটি টাকায়। বিনিয়োগ ২৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ থেকে বেড়ে জিডিপির ৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশে পৌঁছেছে। মাথাপিছু আয়, আমদানি, রফতানি, প্রবাসী আয়, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও বেড়েছে। কমেছে দারিদ্র্য। এসব অর্জনের সুবাদে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতার স্বীকৃতিও মিলেছে। কয়েক বছরের আর্থিক সূচকের ওপর ভিত্তি করেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য বিশাল বাজেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়নের মতো সক্ষম ভিত্তি দেশের অর্থনীতি এখনো পায়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বছর শেষে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাজেটে সব পক্ষকে খুশি করার চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন ঋণের ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা ও পরিধি বাড়ানো, ব্যাংকিং খাতে করপোরেট কর কমানো, ছোট আকারের ফ্ল্যাটে কর কমানোর ঘোষণা রয়েছে। ফলে ব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে বাড়তি রাজস্ব আহরণের সুযোগ কমেছে। এ অবস্থায় ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রায় ৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ বিবেচনায় নিলে বাজেটের আকার দাঁড়ায় ৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। বিশাল ব্যয়ের বিপরীতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের করের মাধ্যমে আসবে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য থাকলেও মন্থর গতির কারণে তা ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৫৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। নতুন অর্থবছর রাজস্বের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে আদায় বাড়াতে হবে ৭৯ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। গত কয়েক বছরের সফলতা তুলে ধরে বাজেটে জুড়ে দেওয়া ফর্দে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, গত ৯ বছরে জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায় এক বছরে রাজস্ব আদায় ৩১ শতাংশ বাড়ানো অসম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ৩০ শতাংশের ওপরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব। এক বছরে রাজস্ব আদায় সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২২ শতাংশ বাড়তে পারে।

আয়ের দুর্বল ভিত্তির ওপরে মোট দেশজ উৎপাদনে ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছেন অর্থমন্ত্রী। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে চাইছেন ৫ দশমিক ৬০ শতাংশে। এ লক্ষ্য পূরণে উন্নয়ন খাতে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩৩ দশমিক ৫৪ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

চলতি অর্থবছর ২২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকার জিডিপির ৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশ হিসেবে বিনিয়োগ হয়েছে ৭ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর লক্ষ্য পূরণ করতে হলে বিনিয়োগ করতে হবে ৮ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে খরার কারণে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ বাড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। বাজেটে দেওয়া অর্থমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল জিডিপির ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছর তা ২৩ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছর ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ২৫ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত করার রসদ বাজেটে নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রবৃদ্ধি সঞ্চারে বড় আকারের অবকাঠামো প্রকল্পে বাড়তি বিনিয়োগের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। আশাবাদ শোনানো হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়েও। তবে এডিপি বাস্তবায়নে স্থবিরতার কারণে বড় প্রকল্পগুলোর কাজ আগামী অর্থবছরের মধ্যে শেষ হচ্ছে না। এর ফলে বাজেটে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রভাব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিকট ভবিষ্যতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, চলতি বছর ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করেছে। মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প সূচক প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। বন্যায় প্রথম দিকে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলেও ভর্তুকি, কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও অন্যান্য সহায়ক কার্যক্রমে আমন ও বোরোর উৎপাদন বেড়েছে। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত ভোগ ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। এরপরও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উৎপাদন ও বাণিজ্যে প্রাণসঞ্চারের ফলে রফতানি, প্রবাস আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ছে। এসব বিষয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

রাজস্ব আহরণে নেওয়া অসম্ভব লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি থাকছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। প্রথা মেনে জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেও মোট বাজেটে ২৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এ ঘাটতি মেটাতে বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া হচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ব্যাংক খাত থেকেই আসবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছর বিদেশি উৎস থেকে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য থাকলেও তা ৪৬ হাজার ২৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণে সামনের বছর বিদেশি সহায়তা বাবদ ৮ হাজার ৪৩ কোটি টাকা বাড়তি সংগ্রহ করতে হবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ লক্ষ্য পূরণ হওয়ার নজির কম। এ অবস্থায় ব্যাংকনির্ভরতা আরো বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক থেকে ১৯ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ হিসাবে আগামী অর্থবছর ব্যাংকের ঋণ দ্বিগুণে উন্নীত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে তারল্য সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় ব্যাংকঋণে নির্ভরতা বাড়লে ব্যক্তিখাতে ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী বাজেটে শুধু সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ ৩১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আগামীতে অভ্যন্তরীণ ঋণ কমিয়ে সুদ ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। সঞ্চয়পত্রের ওপর চাপ কমিয়ে ব্যাংক খাতকে চাঙা করা উচিত ছিল। কিন্তু ঘোষিত বাজেট দেখে মনে হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের দিকেই সরকারের ঝোঁক বেশি।

অর্থ বিভাগের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরেই সরকার বিশাল আকারের রাজস্ব আদায়ের টার্গেট করে। কিন্তু অর্থবছরের শেষ দিকে এসে তা সংশোধন করে কমিয়ে আনা হয়। গত চার বছর ধরে এটি একরকম নিয়মেই পরিণত হয়েছে।

সরকারের রাজস্ব আদায়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে এনবিআর। সংস্থাটির রাজস্ব আদায় গত পাঁচ বছরে গড়ে ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়েছে। গত তিন অর্থবছরে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর সর্বশেষ গত ২০১৬-১৭ অর্থবছর এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। অথচ পাঁচ বছর ধরেই রাজস্ব আহরণে ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অবকাঠামো খাতের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাজেটের আকার বাড়ছে। বিদেশি সহায়তা বাড়িয়ে এসব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় প্রয়োজন ও বাস্তবতার আলোকে যৌক্তিক আকারের বাজেট প্রণয়ন করা উচিত ছিল। বছরের অর্ধেক সময় পরে এ বাজেটে বড় ধরনের সংশোধন প্রয়োজন হবে বলে তিনি মনে করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads