• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী তুষ্টির বাজেট

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট কার্টুন

চিত্রকর : রাকিব

বাজেট

সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী তুষ্টির বাজেট

  • আলতাফ মাসুদ
  • প্রকাশিত ০৮ জুন ২০১৮

দশ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে পাঁচগুণের বেশি। সরকারি বিনিয়োগও বেড়েছে সমানতালে। তবে তুলনামূলকভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ পিছিয়ে থাকায় প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমাও বাড়েনি। অবশ্য নতুন করে করারোপ করা হয়নি। শুধু আয়কর রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য বিশাল বাজেটের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। যে বাজেটের বেশি সুবিধা পাবেন মূলত ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। নতুন বাজেটে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গৃহঋণের সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। আর করপোরেট কর কমিয়ে ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন তিনি।

এবারের বিশাল বাজেট মূলত বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প, বেতন-ভাতা ও সুদ পরিশোধ ব্যয়নির্ভর। আরেকটি অংশ যাচ্ছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি, পরিবহন ও যোগাযোগ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, কৃষি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং সামাজিক নিরাপত্তা। এ ছাড়া ৩৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ।

বাংলাদেশে বিনিয়োগে যেসব অন্তরায় রয়েছে তার মধ্যে উচ্চ করপোরেট করহার অন্যতম। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এ ধরনের ব্যাংক, বীমা ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করপোরেট করহার ৪২.৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের জন্য অতালিকাভুক্ত এ ধরনের কোম্পানির জন্য করহার ৪০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন। তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করপোরেট করহার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৭.৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন তিনি। তবে মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট করহার আগের মতো ৩৭.৫ শতাংশই বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন।

নতুন বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৮ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ ব্যয় ধরা হয় ৫৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় নতুন বাজেটে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় বাড়ছে ১৮ শতাংশের বেশি। জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেডভেদে সরকারি চাকরিজীবীরা সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ ও সর্বনিম্ন ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত গৃণঋণ পাবেন। এর মোট সদুহার ১০ শতাংশ। তবে এ ১০ শতাংশ সুদের ৫ শতাংশ সরকার পরিশোধ করবে।

ভর্তুকি, প্রণোদনা ও পেনশনসহ খাতভিত্তিক সম্পদের ব্যবহারের দিক দিয়ে এবার সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকছে জনপ্রশাসনে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৮ শতাংশ। অবশ্য বাজেটে এ খাতের বড় অংশই ব্যয় হবে বেতন-ভাতায়। আগামী বাজেটে খাতভিত্তিক ব্যয়ের তালিকায় পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত। এতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৭ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় আসন্ন বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বাড়ছে প্রায় ৩৯ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ খাত পরিবহন ও যোগাযোগে ৫৬ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে, যা বাজেটের ১২ দশমিক ২ শতাংশ। এ হিসাবে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণের সুদ খাত। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ৪১ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা রাখা হয়, যা সংশোধিত বাজেটে কমে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৯২১ কোটি টাকায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় নতুন বাজেটে সুদ বাবদ ব্যয় বাড়ছে ৪৫ শতাংশ।

বাজেটে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ৩২ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে তা দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৯৮২ কোটি টাকায়। এ খাতে ২০১৬-১৭ সালের তুলনায় নতুন বাজেটে ব্যয় বাড়ছে ৮২ শতাংশের বেশি।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিরক্ষা খাতে ২৯ হাজার ১০১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী, যা বাজেটের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে বরাদ্দ কিছুটা বাড়িয়ে ২৭ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। নতুন বাজেটে কৃষি এবং জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ করে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি ও বিদ্যুতে বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ৫ শতাংশ, গৃহায়নে ১ দশমিক ১ শতাংশ, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্মে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিসে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ এবং বিবিধ ব্যয় হিসেবে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় ৩৩ হাজার ২০৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রয়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ১৭ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বরাদ্দ প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে। ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ দুই বছরের ব্যবধানে ব্যয় বাড়ছে প্রায় পাঁচগুণ। একই সময়ে সাহায্য মঞ্জুরিও বেড়েছে।

অন্যবারের মতো বড় বাজেট দেওয়া হলেও বিগত বছরগুলোর মতো এবারো বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর, এনবিআর-বহির্ভূত কর, কর ব্যতীত প্রাপ্তি ও সম্ভাব্য বৈদেশিক অনুদান মিলিয়ে রাজস্বপ্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের রাজস্ব প্রাপ্তি ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয় ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা।

রাজস্বপ্রাপ্তির মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) থেকে সংগ্রহের লক্ষ্য সর্বোচ্চ ১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ভ্যাট থেকে সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ৮৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। আয়কর খাত থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৭১৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে আয়কর থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯১ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। আর শুল্ক এবং অন্যান্য কর বাবদ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৮৪ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সম্পূরক শুল্ক ৪৮ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা, আমদানি শুল্ক ৩২ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা, রফতানি শুল্ক ৩৬ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক ২ হাজার ৯০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ১ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরের অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় করার পরিকল্পনা ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ ব্যয় এক লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে করা হয় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads