• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বাজেটের বিশালতা নিয়ে প্রশ্ন

৯ বছরে চারগুণ বড় বাজেট দিয়ে অনেকটাই তৃপ্ত অর্থমন্ত্রী

প্রতীকী ছবি

বাজেট

বাজেটের বিশালতা নিয়ে প্রশ্ন

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ০৯ জুন ২০১৮

২০০৯-১০ অর্থবছরের জন্য ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিলেন তৎকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সেই তিনি আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষণা করেছেন ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বিশাল বাজেট। ৯ বছরে চারগুণ বড় বাজেট দিয়ে অনেকটাই তৃপ্ত অর্থমন্ত্রী। তবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার, ৯ বছরের মূল্যস্ফীতি ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা বিবেচনায় এ বাজেট প্রকৃত অর্থেই বিশাল কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো অগ্রাধিকার খাতে বরাদ্দ বিবেচনায় নিলে এ বাজেট প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ছোট। আর রাজস্ব আদায় ও অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতার বিষয়টি আমলে নিলে এ বাজেট বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হবে।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রায় ৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরে বাজেটের আকার দাঁড়ায় ৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। এবার আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর থেকে আসবে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি আর এনবিআর-বহির্ভূত করব্যবস্থা থেকে সংগৃহীত হবে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা।

নতুন বাজেট কতটা বিশাল- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রকৃত অর্থেই বিশাল বাজেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থ ব্যয়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অদক্ষতা বিবেচনায়ও বাজেটের আকার অনেক বড়। তার মতে, আয় ও ব্যয় প্রত্যাশিত হারে না হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যাবে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য কমানো হবে। পাশাপাশি কমবে ব্যয়ের লক্ষ্যও।

তবে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে অবকাঠামোয় বিনিয়োগ, মানবসম্পদের উন্নয়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রস্তাবিত বরাদ্দ নিয়ে কিছুটা হতাশ এ অর্থনীতিবিদ। আর সামাজিক নিরাপত্তার আওতা, পরিধি ও ব্যয় বাড়লেও চাহিদার তুলনায় এ খাতে বরাদ্দ বরাবরই কম থাকছে বলে তিনি মনে করেন। ড. মনসুর বলেন, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দেড় কোটির বেশি। এ অবস্থায় মাত্র ৭৮ লাখ সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় এসেছেন। এসব খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হলে বাজেটের আকার আরো বাড়াতে হবে বলে জানান তিনি।

রাজস্ব আহরণে বরাবরই বড় নির্ভরতা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন কর। এ খাতে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছর ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল এনবিআরের মাধ্যমে। যদিও প্রত্যাশিত গতি না থাকায় পরে তা ২ লাখ ২৫ হাজার কোটিতে নামিয়ে আনা হয়। নতুন অর্থবছরে এনবিআরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ৭১ হাজার ২০১ কোটি টাকার রাজস্ব।

আগামী অর্থবছর রাজস্ব আদায়ে ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিশাল লক্ষ্য পূরণের সম্ভাবনা ও ঘোষিত বাজেটে এ-সংক্রান্ত উদ্যোগ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নির্বাচনী বছরের বাজেটে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ না থাকায় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ হবে না। রাজস্বসংক্রান্ত কিছু উদ্যোগের কারণে আদায় উল্টো কমে যেতে পারে।

তিনি বলেন, ৭ থেকে কমিয়ে মূল্য সংযোজন করের (মূসক) স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে ৫টি। এর ফলে সরলীকরণ হলেও মূসক আদায় বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিশ্চিত হচ্ছে না। ই-কমার্সে পণ্য বেচাকেনায় ৫ শতাংশ কর আরোপ হলেও তা আদায় সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ হবে। দেশি শিল্প সুরক্ষার কথা বলে মোবাইল ও ফ্রিজ তৈরির উপকরণে ছাড় দেওয়া হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে করপোরেট কর কমিয়ে আনার কারণে বৃহৎ করদাতা ইউনিটের আদায় লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে। এ সময়ে অনলাইনে মূসক দেওয়ার পদ্ধতিও কার্যকর হয়নি। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কমাতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

পর্যাপ্ত আয়ের সম্ভাবনা না থাকলে ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরার প্রবণতা রয়েছে অর্থনীতিতে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে এমন কোনো বিকল্প খোলা ছিল কি না, জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন বলেন, আগামী বাজেটে ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্ট খাতে ২৪ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এ বরাদ্দের বড় অংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে ব্যয় হতে পারে। এ খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে বরাদ্দ কমানো সম্ভব হবে। তিনি আরো বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে আগেই বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় নতুন করে কর ছাড় দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ বরাদ্দ ১৬ হাজার ৬৫৬ কোটি থেকে ২৯ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বিভিন্ন খাতেও ভর্তুকি বাড়ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ছাড়াও ভাতার জন্য রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে চলতি অর্থবছর ৭৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও নতুন বছরের জন্য থাকছে ২ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করে এসব খাতে অর্থ ব্যয়ে সতর্কতা প্রয়োজন বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।

জাতীয় বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয় জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তুলনা করে। ২০০৯-১০ বছর থেকে এ পর্যন্ত অর্থনীতিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬৯ শতাংশ। ১০০ টাকায় ওই সময় যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা কেনা যেত, তা কিনতে এখন ১৬৯ টাকা লাগবে। এ হিসাবে বাজেটের আকার টাকার অঙ্কে চারগুণে উন্নীত হলেও প্রকৃত অর্থে বাজেট বৃদ্ধির হার দ্বিগুণের সামান্য বেশি। আর জিডিপির হারের সঙ্গে তুলনা করলে এ সময়ে বাজেটের আকার বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৯১ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা জিডিপির বিপরীতে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। ওই বছর ব্যয় দেখানো হয়েছিল জিডিপির ১৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। আর আগামী অর্থবছর ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকার প্রত্যাশিত জিডিপির ১৮ দশমিক ৩০ শতাংশ বরাদ্দ থাকছে বাজেট বাস্তবায়নে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের আকার উন্নয়নশীল দেশের বাজেট-জিডিপি অনুপাত থেকে কম। ভারতে বাজেট-জিডিপি অনুপাত ২৬ ও মালেশিয়ায় ২৭ শতাংশ। তিনি বলেন, ছোট বাজেট দিয়েও গত বছর ২১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বাজেট বাস্তবায়নের হার কমছে। ওই বছর বাজেটের ৯৩ শতাংশ বাস্তবায়িত হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে তা আরো কমে আসে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৯১, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৮৫, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৮২, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭৯ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭৮ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে।

অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে তাল রেখে জিডিপির বিবেচনায় বাজেটের আকার বৃদ্ধি না পাওয়ায় অগ্রাধিকার খাতে বরাদ্দ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আগামী অর্থবছরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে টাকা বাড়লেও বাজেটের আকারের তুলনায় তা কমেছে। শিক্ষার বরাদ্দ এক দশক ধরেই জিডিপির ২ শতাংশে সীমাবদ্ধ। এ বিষয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, জিডিপির অংশ হিসেবে শিক্ষায় বরাদ্দে পতন ঘটেছে। জিডিপির মাত্র দুই শতাংশ শিক্ষায় খরচ করে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads