• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
এডিপি বাস্তবায়ন একই বৃত্তে

এডিপি বাস্তবায়ন একই বৃত্তে

প্রতীকী ছবি

বাজেট

এডিপি বাস্তবায়ন একই বৃত্তে

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ২০ অক্টোবর ২০১৮

একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন। বছরের শুরুতে ব্যয় বাড়াতে সরকারের নেওয়া নানামুখী পদক্ষেপ ভেস্তে যাচ্ছে। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও অবস্থার উন্নতি হয়নি। পরিস্থিতি তিমিরেই রয়ে গেছে। উল্টো অবস্থার কিছুটা অবনতি ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থবছরের শুরুতে এডিপি বাস্তবায়নের শ্লথগতির কারণে শেষ দিকে ব্যয়ের চাপ বাড়বে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুণগত মান রক্ষা করা সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে অপচয়ের আশঙ্কাও বাড়ছে। 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সব উদ্যোগ ব্যর্থ করে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ সময়ে এডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের এ সময়ে এডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছিল ১৬ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। শতকরা হিসেবে বাস্তবায়ন হার ছিল ১০ দশমিক ২১ ভাগ। আইএমইডি সূত্র জানিয়েছে, বছরের ব্যবধানে বাস্তবায়ন হারের পাশাপাশি কমেছে প্রকৃত উন্নয়ন ব্যয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এডিপির ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা ছিল ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এডিপি বাস্তবায়ন। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয় ১০ দশমিক ২১ শতাংশ। বাস্তবায়ন হার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে ওঠাতে শেষ তিন মাসে ব্যয় হয় ৪৪ শতাংশের বেশি অর্থ। প্রথম প্রান্তিকে ১৬ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে শেষের এক মাসেই ব্যয় হয় ৪৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা।

অর্থবছরের শুরুতে স্থবির থাকা এডিপি বাস্তবায়নে শেষের দিকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করায় কাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শুরুতে কাজ করা না হলে অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল থেকে জুন) প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। ওই সময়ে এমনিতেই বৃষ্টিপাত হয়। এডিপির প্রকল্পের বড় অংশ ব্যয় হয় নির্মাণকাজে। বৃষ্টির সময়ে কাজ হলে  গুণগত মান নিশ্চিত হয় না। শেষ দিকে ব্যয়ের বড় একটা অংশ অপচয় হয় বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শুরুর দিকে উন্নয়ন কাজে গতি আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাগিদ দিয়ে আসছেন। গত অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠিও দেওয়া হয়। চিঠিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কাজ শেষ না হলে নতুন করে প্রকল্প অনুমোদন, দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা প্রকল্প বাতিলেরও নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এত সব নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে কাজে আসছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য এটা পুরনো সমস্যা। বছরের শুরু থেকে প্রকল্প ফেলে রেখে শেষ দিকে দায়সারা কাজ করা হয়। বর্তমান সরকারও এ বিষয়ে অবহিত। বছরের শুরুতে কাজ করতে প্রতিবারই নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো নির্দেশনারই বাস্তবায়ন হয় না। তিনি বলেন, একসঙ্গে বেশি প্রকল্প নেওয়ায় বাস্তবায়নে গতি আসে না। শেষ দিকে কিছু কাজ করে টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়। এতে জনগণের কোনো কাজে আসে না।

আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে তিন মাসে এডিপি বাস্তবায়নে শীর্ষে রয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। ৩ হাজার ৩৩৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে বিভাগটি এ পর্যন্ত ব্যয় করেছে ১ হাজার ৪৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে খাদ্য মন্ত্রণালয়; প্রথম তিন মাসে তাদের এডিপি বাস্তবায়ন হার ২৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ৭২২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বরাদ্দ নিয়ে মন্ত্রণালয়টি ব্যয় করেছে ১৮৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ১৬ দশমিক ৯১ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করে চতুর্থ অবস্থানে বিদ্যুৎ বিভাগ; তিন মাসে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৩০০ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয় করেছে তারা। ৯৫ প্রকল্পের আওতায় বিদ্যুৎ বিভাগে এবার বরাদ্দ আছে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৪৩৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এডিপি বাস্তবায়নে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩১৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। ২৩ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দের ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে বিভাগটি।

বেশি বরাদ্দ পাওয়া ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে ৭টির বাস্তবায়ন হার ৫ শতাংশেরও কম। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ২০ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে মাত্র ৭৯৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। বাস্তবায়নের হার ৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ১০ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের মাত্র ১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সেতু বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন হার ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। এ ছাড়া বড় বরাদ্দ পাওয়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ প্রথম প্রান্তিকে এডিপির ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ ব্যয় করেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ২ দশমিক ৭১ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে।

সূত্র জানায়, এডিপি বাস্তবায়নে এবার শুরু থেকেই গতি আসবে বলে জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাজেট উপস্থাপনের সময় সংসদে তিনি বলেছিলেন, এডিপি বাস্তবায়নে গতি আনতে শুরু থেকেই অর্থ ছাড় দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ধাপে ধাপে অর্থ ছাড়ের কারণে সৃষ্ট স্থবিরতা থেকে বেরিয়ে আসবে বাস্তবায়ন। প্রকল্প পরিচালকরা ১ জুলাই থেকেই প্রকল্পের অর্থ ছাড় করার ক্ষমতা পাওয়ায় এবার শুরুতেই এডিপি বাস্তবায়নে গতি আসবে বলে আশার কথা শুনিয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি শুরুতেই এডিপি বাস্তবায়নে গতি আনার তাগিদও দিয়েছেন।

জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব মো. মফিজুল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সারা বছর ধরে কাজ হলেও ঠিকাদারের বিল অর্থবছরের শেষের দিকেই বেশি পরিশোধ করা হয়ে থাকে। এর ফলে শেষের দিকে বাড়তি বাস্তবায়ন দেখা যায়। সার্বিক অর্থনীতির শৃঙ্খলার স্বার্থে এ বিষয়টি কাম্য নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের জন্য ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার এডিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ও বিদেশি সহায়তা থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বাস্তবায়নকারী সংস্থার তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। তিন মাসে সরকারের তহবিল থেকে ৮ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ খাতে বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বিদেশি সহায়তার ৫ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা (৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ) ও সংস্থার তহবিলের ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা (১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ) অর্থ ব্যয় হয়েছে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads