• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
তবু মিটছে না প্রয়োজন

ছবি : সংগৃহীত

বাজেট

ঘরে বাইরে বাড়ল কর

তবু মিটছে না প্রয়োজন

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ১৫ জুন ২০১৯

সরকার পরিচালনা আর উচ্চ আয়ের জ্বালানি জোগাতে শিশুর গুঁড়োদুধ থেকে প্রবীণের চশমা পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্যেই আরোপ করা হচ্ছে নতুন কর। রেহাই পাচ্ছে না ড্রইং রুমের টিউব লাইট, রান্নাঘরের গুঁড়া মসলা, সয়াবিন ও পাম তেল, টয়লেটের টিস্যুসহ বিভিন্ন পণ্য। রান্নার এলপি গ্যাস, হাঁড়ি-পাতিল, প্লাস্টিকের গৃহস্থালি সামগ্রী, থালা-বাসনেও বসছে নতুন কর। মোবইল ফোনের কল ও হ্যান্ডসেটের ওপর নতুন করের কারণে কথা বলার ব্যয় বাড়বে। কর আরোপের কারণে বাড়বে পরিবহন ব্যয়ও। ঘরে বাইরে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির উদ্যোগ রেখে প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। দেশে বিদেশে ধার-দেনা করে আগামী এক বছরে ব্যয় করা হবে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আয়ের বিবেচনায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ঘোষণা করা প্রথম বাজেটের আকার বিশাল মনে হলেও প্রত্যাশিত বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়নি অনেক প্রয়োজনীয় খাতে। দেশকে উচ্চ-মাধ্যম আয় তথা সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় রসদও বাজেটে নেই বলেও মনে করছেন অনেকেই।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ৯৪ লাখ ৭১ হাজার ১০০ কোটি টাকা লাগবে। ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি লাগবে বলে জানিয়েছে জিইডি। গত কয়েক বছর ধরেই জাতীয় বাজেটের আকার ৪ লাখ কোটি টাকার মধ্যে আছে। এ হিসাবে বছরপ্রতি বাড়তি অর্থের চাহিদা আরো বেড়েছে। এ বিবেচনায় ঘোষিত বাজেট এসডিজি অর্জনে সহায়ক হবে না বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

আগামী অর্থবছরের প্রত্যাশিত বাজেটের আকার প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে দাবি করা হয়েছে জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি শীর্ষক পুস্তিকায়। এতে বলা হয়েছে, কয়েক বছর ধরেই বাজেটের আকার মোট দেশজ উৎপাদনের ১৪ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। নতুন বছরের বাজেট শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারলে এতে ব্যয় হবে জিডিপির ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ অর্থ। অথচ প্রতিবেশী ভারত জিডিপির ২৭ দশমিক ২৮ শতাংশ অর্থ বাজেটে ব্যয় করছে চলতি বছর। নেপালের বাজেট ব্যয় জিডিপির ৩২ শতাংশের বেশি। ভিয়েতনাম জিডিপির ২৮ দশমিক ২২ শতাংশ, মালয়েশিয়া ২২ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ফ্রান্স ৫৬ দশমিক ১৬ শতাংশ ও ডেনমার্ক ৫২ দশমিক ২২ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে বাজেট বাস্তবায়নে।

সূত্র জানায়, মহাজোটের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০০৯-১০ অর্থবছরের জন্য ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিলেন তৎকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার উত্তরসূরি আ হ ম মুস্তফা কামালের ঘোষিত বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ১০ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ গুণ। একই সময়ে বেড়েছে জিডিপির আকার। ১০ বছরের মূল্যস্ফীতি যোগ করলে বরাদ্দের চাহিদাও বেড়েছে সমহারে। এর ফলে আকার বাড়লেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো অগ্রাধিকার খাতে বরাদ্দের বিবেচনায় ঘোষিত বাজেটের আকার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।

নতুন বাজেটের আকারের বিশালতা জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকৃত অর্থেই বিশাল বাজেট দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থ ব্যয়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অদক্ষতা বিবেচনায়ও বাজেটের আকার অনেক বড়। তার মতে, আয় ও ব্যয় প্রত্যাশিত হারে না হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য কমানোর পাশাপাশি ব্যয়ের লক্ষ্যও কমাতে হবে।

তবে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ, মানবসম্পদের উন্নতিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নতি নিশ্চিত করতে বরাদ্দ নিয়ে কিছুটা হতাশ এ অর্থনীতিবিদ। সামাজিক নিরাপত্তার আওতা, পরিধি ও ব্যয় বাড়লেও চাহিদার তুলনায় এ খাতে বরাদ্দ বরাবরই কম থাকছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দেড় কোটির বেশি। এ অবস্থায় মাত্র ৭৮ লাখ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় এসেছেন। এসব খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হলে বাজেটের আকার আরো বাড়াতে হবে বলে তিনি জানান।

নতুন অর্থবছরে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৬১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা বেশি আহরণ করতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রায় ৩০ শতাংশ করে বেশি রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়। এ বিবেচনায় এক বছরে রাজস্বে ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যকে তুলনামূলক যৌক্তিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন,  মোবাইল ফোনের কল ও এসএমএসের ওপর ৫ শতাংশ বাড়তি সম্পূরক শুল্কের কারণে যোগাযোগের খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজস্বও বাড়বে। সিগারেটের ওপর বাড়তি করের কারণেও কিছুটা রাজস্ব বাড়বে। তবে কাঠামোর বদল না হলে তামাক আর মোবাইলের কর অর্থনীতিকে সামনে নিয়ে যেতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারবে না। এ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে।

তিনি আরো বলেন, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন কার্যকর করার উদ্যোগ থাকলেও মূসকের হার এক স্থলে নিয়ে আসতে না পারায় রাজস্ব আহরণে বড় লক্ষ্য পূরণে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মূসক ধরা হলেও বেশিরভাগ পণ্যের মূসক ধরা হয়েছে ৫ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশের মধ্যে। রাজস্ব আহরণে ঘাটতি থাকায় অনেক খাতে পর্যাপ্ত অর্থ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এখনো জিডিপির ২ শতাংশের কম। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেড় শতাংশের কম। পেনশন বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ জিডিপির দেড় শতাংশ। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ সাড়ে ৪ শতাংশের মতো। অনেক দেশের তুলনায় এসব খাতে বাংলাদেশে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে কম।

জাতীয় বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয় জিডিপির আকার ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তুলনা করে। ২০০৯-১০ বছর থেকে এ পর্যন্ত অর্থনীতিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭৪ শতাংশ। ১০০ টাকায় ওই সময় যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা কেনা যেত, তা কিনতে এখন ১৬৯ টাকা লাগবে। এ হিসাবে বাজেটের আকার টাকার অঙ্কে চারগুণে উন্নীত হলেও প্রকৃত অর্থে বাজেট বৃদ্ধির হার দ্বিগুণের সামান্য বেশি। আর জিডিপির হারের সঙ্গে তুলনা করলে এ সময়ে বাজেটের আকার বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৯১ শতাংশ।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, সংসদে ঘোষণা করা বাজেটের আকার উন্নয়নশীল দেশের বাজেট-জিডিপি অনুপাত থেকে কম। ছোট বাজেট দিয়েও গত বছর ২১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বাজেট বাস্তবায়নের হার কমছে। ওই বছর বাজটের ৯৩ শতাংশ বাস্তবায়িত হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে আরো কমে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৯১ শতাংশ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৮৫ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৮২ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭৯ শতাংশও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭৮ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads