• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
সংস্কৃতি অঙ্গনে অসন্তোষ

ছবি : সংগৃহীত

বাজেট

প্রস্তাবিত বাজেট ২০১৯-২০

সংস্কৃতি অঙ্গনে অসন্তোষ

  • সোহেল অটল
  • প্রকাশিত ১৭ জুন ২০১৯

মানুষের মনোজগতে দেশাত্মবোধের জাগরণ, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টি এবং কল্যাণমুখী বিশ্বমানস গঠনে সংস্কৃতিচর্চার ধারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে স্কুল পর্যায়ে শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় পাঠ্য করা, স্কুলে স্কুলে সংগীত, নৃত্য, নাট্যকলা ও চারুকলার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার দাবি রয়েছে সংস্কৃতিকর্মীদের। অথচ জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সংস্কৃতি খাতকে বরাবরের মতোই উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে সংস্কৃতি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

জেলা-উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমিগুলোকে আরো শক্তিশালী করা, কাজের পরিধি বাড়ানো, জনবল নিয়োগ, মিলনায়তন নির্মাণ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে সংস্কৃতিকেন্দ্র নির্মাণ করে সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রকে আরো প্রসারিত করার কথা থাকলেও বাজেটে সে উদ্দেশ্য পূরণের কিছু নেই। যে কারণে কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অগ্রগতি থেকে বঞ্চিত হবে।

গত অর্থবছরের তুলনায় এবার জাতীয় বাজেটের পরিমাণ বেড়েছে। বাজেট ঘোষণার আগে সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রতিনিধিদের দাবি ছিল, সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ যেন বাড়ানো হয়। ঘোষণার পর দেখা গেল, সেটা না বেড়ে উল্টো কমেছে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাজেটে বরাদ্দ কমেছে ৮ শতাংশ। এ নিয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রতিনিধিরা।

গত বৃহস্পতিবার বাজেট ঘোষণার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। গত শনিবার বিকেল পাঁচটায় দেশব্যাপী প্রতিবাদ সভা ডেকেছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। একই সময়ে সারা দেশে প্রতিবাদ সভা করে ফেডারেশনের সব শাখা। এ নিয়ে গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন ডাকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সেখানে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন জোটের কর্মীরা।

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে ৫৭৫ কোটি টাকা। এই বাজেট দেশের সংস্কৃতি চর্চার জন্য মোটেই সন্তোষজনক নয় বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। গত বছর এ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ৫১০ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেট ছিল ৬২৫ কোটি টাকা।

বাজেটোত্তর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ড. সফিউদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন বলেন, সরকার নিজেদের সংস্কৃতিবান্ধব বলে দাবি করে। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ নির্মূলে সারা দেশে সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা সরকারের দায়িত্বশীল লোকজনই বিভিন্ন সময় বলেছেন। অথচ সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে তাদের কথা বা প্রতিশ্রুতির কোনো প্রতিফলন চোখে পড়েনি। উপরন্তু গতবারের চেয়ে এবার এ খাতের বরাদ্দ কমেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের সাম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদার এবারের প্রস্তাবিত বাজেটকে হতাশাজনক মন্তব্য করে বলেন, একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে, জঙ্গিবাদ ও মাদকের ভয়াবহতা দূরীকরণের লক্ষ্যে সংস্কৃতি খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো অত্যাবশ্যক ছিল। কিন্তু বাজেটপ্রণেতারা সে পথে না হেঁটে, হেঁটেছে ভিন্ন পথে।

তিনি বলেন, আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়েরও অক্ষমতা আছে। যুক্তি দেখিয়ে বেশি বরাদ্দ চাওয়ার মতো শক্তি তাদের আছে বলে মনে হয় না। বাজেটে বরাদ্দ করা টাকাও তারা ঠিকমতো খরচ করতে পারে না।

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, সংস্কৃতি খাতে আমরা কখনোই কাঙ্ক্ষিত বাজেট পাইনি। সংস্কৃতি বরাবরই উপেক্ষিত ছিল। সার্বিকভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সামগ্রিক বিকাশের লক্ষ্যে যে ধরনের কর্মযজ্ঞ প্রয়োজন, সেটার বরাদ্দ নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, এই খাতকে মোটেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তারা মনে করে, এরা শুধু গানবাজনা করে বেড়ায়। এ আর এমন কী?

সংস্কৃতির বাজেট নিয়ে হতাশার কথা জানিয়ে এই সংগঠক বলেন, একটি বাজেটে তো সরকারের নীতি ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটে। সরকার একদিকে বলছে, আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সংস্কৃতিবান্ধব জাতি, মানুষে মানুষে মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাজেটে সরকারের সেই সব কথার প্রতিফলন ঘটল না।

সংস্কৃতিকর্মীরা মনে করেন, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রণোদনা হিসেবে এই বাজেট অপ্রতুল। তাদের প্রস্তাব ছিল, জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ১ শতাংশ সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হোক। সেটা না হলে সাংস্কৃতিক জাগরণ সম্ভব হবে না। তারা আশা করছেন, এখনো সেই সুযোগ আছে। তাদের বিশ্বাস, শিগগিরই প্রস্তাবিত বাজেট সংশোধন করে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ বাড়াবে সরকার।

একটি সমৃদ্ধ জাতি ও সভ্যতা বিনির্মাণে সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন যে প্রভাবক ভূমিকা রাখে, সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ কমিয়ে সরকার সে সত্যকে অস্বীকার করেছে। বাজেটের আকারের সঙ্গে সংস্কৃতি খাতের বরাদ্দ একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অপ্রতুল। অথচ গোটা বাজেটে লুটেরা অর্থনীতিকে উৎসাহিত করতে নানা ধরনের প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধার প্রস্তাব আনা হয়েছে বলে সংস্কৃতিকর্মীদের অনেকেই মনে করছেন। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি খাতকে চরম অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads