• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ক্যাম্পাস

অনলাইন ক্লাসের বাইরে দুই কোটি শিক্ষার্থী

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৪ অক্টোবর ২০২০

অর্থ এবং প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাবে অন্তত দুই কোটি শিক্ষার্থী অনলাইনের ক্লাসে যোগ দিতে পারছে না। করোনাকালে মানুষের আয় কমে যাওয়ার পর ইন্টারনেটের জন্য খরচ করে পড়াশোনা করানো বহু পরিবারের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয় যে বিকল্প করা হয়েছে, সে টেলিভিশন দেখে পড়াশোনার সুযোগও সীমিত। কারণ, যাদের বাসায় টিভি নেই তারা এ সুবিধার বাইরে। আবার অনেকের অর্থের সমস্যা না থাকলেও কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয় সে সম্পর্কে ধারণা না থাকায় অনলাইনের ক্লাসে তারা অংশ নিতে পারছে না।

এবিষয়ে ঢাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সারোয়ার জাহান বলেন, আমাদেরকে বলা হযেছে ফোনে শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর রাখতে। কিন্তু ঢাকায় সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে কারা পড়ে সে সম্পর্কে কম-বেশি সবাই জানে। এত ছেলেমেয়েকে ফোনে পাওয়া দুরুহ। তাদের পরিবার তো পড়ালেখার বিষয়ে সেভাবে সচেতনও না। আমরা কল করলেও প্রায়ই তারা ধরেও না। তবে স্কুলে যেদিন শিশুদের বিস্কুট দেওয়া হয়, সেদিন ঠিকই দল বেঁধে চলে আসে। সেদিন আমরা তাদের পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক বলি, বোঝায়। কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট জমা পড়ে না বললেই চলে। তাছাড়া শিক্ষকদের জন্য বাড়তি কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। কত জনকে ফোন দেওয়া যায়?

যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান বলেন, নিঃসন্দেহে করোনাকাল দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় বৈষম্য ও বিভাজন সৃষ্টি করছে। ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে অনেক শিক্ষার্থী তো ঝরে পড়বেই। টিকে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও মোটাদাগে দুইটি শ্রেণি গড়ে ওঠবে। আর্থিক কারণে অনেক শিক্ষার্থীই পিছিয়ে পড়বে। যা মোটেও সুখকর নয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যতে আমি বড় দুর্যোগ দেখতে পারছি। এ অবস্থা চলমান থাকলে ২০৩০ সালে শিক্ষাখাতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অধরা রয়ে যাবে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ওপর করা জরিপের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারীতে স্কুল বন্ধ থাকায় তিন কোটি ৬০ লাখ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাথমিক স্কুল আছে ৬৪ হাজার। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিক স্কুল আছে আরো ১৭ হাজারের মতো। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় আছে প্রায় আড়াই হাজার। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষার্থীদের ৮৬ শতাংশ ও অভিভাবকদের ৭৪ শতাংশ সংসদ টিভির বিষয়ে জানেন না। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সংসদ টেলিভিশনের ক্লাস দেখেছে। বাকি ৫৭ শতাংশ এই টিভি বা অনলাইন ক্লাসের বাইরে থেকে গেছে।

ঝিনাইদহ জেলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রেজাউল করিম জানায়, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বাবার মুদি দোকানে বসতে হয়। ২৯ মার্চ ক্লাস চালু হওয়ার পর দু-তিনটি ক্লাসে অংশ নিতে পেরেছে। তার বাবা বলেন, গ্রামে অনেক সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। প্রায় দিনই ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেছে। তাছাড়া স্কুলের চাপ ও পরীক্ষা না থাকায় ছেলেরও পড়শোনার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই।

বিপরীত চিত্র রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মুশতারির পরিবারে। তার বাবা-মা সম্পদশালী। অভিভাবকও সচেতন। তিনজন হোম শিক্ষক দিয়ে চলছে পড়াশোনা। অনলাইনে ক্লাস চলছে নিয়মিত। পরীক্ষাও নিচ্ছে তার স্কুল। গ্রামীণ মানুষের ডিজিটাল শিক্ষা ও বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে ব্র্যাক ইনস্টিটিটিউট অব গভারনেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) দুটি জরিপেও। এতে দেখা গেছে, গ্রামের ৪১ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করে। ৯ শতাংশের কম্পিউটার চালানোর দক্ষতা আছে। ইন্টারনেট সংযোগ আছে ৩৭ শতাংশের। ইন্টারনেট সুবিধা ভালো ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায়। সব থেকে খারাপ অবস্থায় রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগ।

খুলনার রূপসা বহুমুখী বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের ২৫ ভাগ পরিচালিত হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক জানান, ফেসবুক লাইভ, মেসেঞ্জার ও ইউটিউবের মাধ্যমে তারা ক্লাস নিচ্ছেন। প্রত্যেক শিক্ষককে মাসে কমপক্ষে চারটি ক্লাস অনলাইনে নিতে হয়। স্কুলের শিক্ষক অমিয় কান্তি পাল বলেন, বিদ্যালয়ের ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীর মোবাইল না থাকায় তাদের নিকটবর্তী শিক্ষার্থীদের সহায়তা নিতে বলা হয়েছে।

বরিশাল জেলার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় তারা অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। একই অবস্থা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করলেও শিক্ষার্থীরা এর বিরোধিতা করে আসছে। কারণ হিসেবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ডিজিটাল ডিভাইস ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কথা বলছে। ফলে অনলাইন ক্লাস চললেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ৩০ শতাংশের মতো।

মৌলভীবাজারে এক হাজার ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষা কার্যক্রম চলছে সংসদ টিভি ও মোবাইলের মাধ্যমে। তবে বড়লেখা ও জুড়িসহ বেশকিছু উপজেলায় ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা নেই। অভাব আছে স্মার্টফোনেরও। ফলে এসব শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না।

এবিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইইআর) বিভাগের প্রভাষক ইফফাত নায়মি বলেন, ইন্টারনেটের সহজপ্রাপ্যতা আর বিঘ্ন একটা বড় সমস্যা। কেউই এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ এসেছে এবং আমরা সবাই মিলে সেটাকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরা বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। কারণ শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীদের ভালো চেনেন। তাই ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ফোনের সাহায্যে বা অন্য কোনো মাধ্যমে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফসিউল্লাহ বলেন, গ্রামাঞ্চলে টিভিতে কেবল্ সংযোগ নেই। এ কারণে অনেকেই হয়তো ক্লাসের বাইরে থাকছে। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, কেবল্ নেটওয়ার্কে সংসদ টিভি দেখতে যাতে কারো সমস্যা না হয়। আমাদের লক্ষ্য সব শিক্ষার্থী যাতে ঘরে বসে ক্লাস করতে পারে। যারা বিভিন্ন কারণে ক্লাস করতে পারেনি, তাদের কথা মাথায় রেখে উত্তরণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিনামূল্য ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অনেক গ্রামের শিক্ষার্থীদের ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আনার পরিকল্পনাও আছে। করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads