• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

মহানগর

চাঁদাবাজিতে গণপরিবহনে নৈরাজ্য

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

রাজধানীর গণপরিবহনে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘাত-রক্তপাত কম হয়নি। তবে থামেনি নৈরাজ্য। পরিবহন খাতের এই অরাজকতা ঠেকাতে প্রশাসন কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্রেণির মালিক-শ্রমিক সড়ক পরিবহন খাতকে জিম্মি করে রেখেছে, যার প্রভাব পড়ছে সাধারণ জনগণের ওপর। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য মতে, রাজধানীর ১৬১ রুটে প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করে। বিভিন্ন রুটে হিউম্যান হলার চলে ৩ হাজার ৭৭টি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব বাস-মিনিবাসকে পথে-পথে দিতে হয় বিভিন্ন পরিমাণ চাঁদা। ওয়েবিল বা শ্রমিক সংগঠনের নামে আদায় করা চাঁদার টাকা যায় পুলিশ ও প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মহলের পকেটে। হিউম্যান হলারে (লেগুনা) চাঁদাবাজির কৌশলটা ভিন্ন। স্থানভেদে প্রতিদিন লেগুনাপ্রতি চাঁদা দিতে হয় সাড়ে চারশ’ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। কয়েক ধাপে এ টাকা আদায় করা হয়, যার জন্য থাকে বিট সুপারভাইজার। সব মিলে গণপরিবহন খাতে রাজধানীতে মাসে ১৫ কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হচ্ছে। এই টাকা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে সরকারি দল সমর্থিত বিভিন্ন মালিক-শ্রমিক সংগঠন, স্থানীয় রাজনৈতিক সংঘবদ্ধ শক্তি, পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা।

জানা গেছে, টার্মিনাল থেকে বাস ছাড়ার আগেই শুরু হয় চাঁদাবাজি। প্রথম পর্বে ‘টার্মিনাল চাঁদা’ নামে পরিচিত খাতে দিতে হয় ৫০০ টাকা। সিটি করপোরেশনের ইজারাদার ও সিরিয়ালের জন্য প্রায় ১০০ টাকা। এরপর হয় রাস্তার চাঁদাবাজি। গুলিস্তান-গাজীপুর রুটে ছয়টি স্পটে চাঁদা দিতে হয়। এসব স্পটে দাঁড়িয়ে থাকা আদায়কারীকে প্রতিদিন একটি বাসকে প্রায় এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গুলিস্তান থেকে গাজীপুর যেতে একটি বাসকে চাঁদা দিতে হয় বারিধারা (নতুনবাজার), খিলক্ষেত, এয়ারপোর্ট, আজমপুর আবদুল্লাহপুর ও গাজীপুর স্পটে। প্রতি স্পটেই এক থেকে দুই যুবক হাত উঁচিয়ে বাস থামার নির্দেশ দিলে চালক সহকারী তাদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেন।

একই চিত্র মিলেছে মতিঝিল-মিরপুর রুটেও। এই রুটে শিকড়, সময় নিয়ন্ত্রণ ও দিশারীসহ কয়েকটি পরিবহনের প্রায় এক হাজার বাস চলাচল করে। সূত্র জানায়, প্রতি ট্রিপে একটি বাসের মালিককে কমপক্ষে সাড়ে ৮০০ টাকা গুনতে হয়। এর মধ্যে টার্মিনাল চাঁদা ৪৫০ টাকা এবং সিরিয়াল ও সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে দিতে হয় বাকি টাকা।

কেন এ টাকা দেওয়া হচ্ছে-জানতে চাইলে বেশ কয়েকজন চালক ও কন্ডাক্টর জানান, লাইনম্যানের নামে ক্ষমতাসীন দলের শ্রমিক সংগঠন এ টাকা নেয়। না দিলে গাড়ি চালানো যাবে না। কারণ হিসেবে তারা জানান, ফিটনেস ও রুট পারমিটসহ নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে অধিকাংশ বাসের। তাই মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতরা প্রতি মাসে এই টাকা দিয়ে মাঠ প্রশাসন ঠিক রাখেন।

পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ঢাকা-গাজীপুর ও মতিঝিল-মিরপুর রুটে মাসে গড়ে চাঁদা ওঠে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। গুলিস্তান, মতিঝিল, গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া বাস থেকে প্রতিদিন সাড়ে পাঁচশ’ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এ পাঁচ টার্মিনাল থেকে মাসে ১২ কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। এ ছাড়া রাজধানীতে চলা সিটিং সার্ভিসের প্রতিটি কোম্পানি থেকে মালিক সমিতির নামে প্রতি মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে।

তারা জানান, এ টাকার ক্ষুদ্র একটি অংশ সমিতির নামে ব্যাংক হিসাবে জমা হয়; বড় অংশই চলে যায় সমিতির নামধারী নেতাদের পকেটে। এর বাইরে ‘পুলিশ খরচা’ বাবদ বাসপ্রতি সাড়ে পাঁচশ’ টাকা দিতে হয়। এ টাকা যখন-তখন পুলিশের রিকুইজিশন বন্ধ করার জন্য নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন মালিক সমিতির নেতাকর্মীরা।

ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির এক নেতা বলেন, গত চার বছরে রাজধানীতে প্রায় ২০টি নতুন রুটে বাস নেমেছে। এসব রুটের নিয়ন্ত্রণ ও পরিবহনগুলোর মালিকানা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের হাতে। দলীয় পরিচয় ছাড়া নতুন কোনো ব্যবসায়ী বাস নামাতে চাইলে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট রুট মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ধার্য করে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। যেসব প্রাইভেট মাইক্রোবাস ভাড়ায় খাটে সেগুলোকেও একটি নির্দিষ্ট চাঁদা পুলিশ ও নেতাদের দিতে হয়।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশর যানজট নিরসন প্রকল্পের পরামর্শক ড. এসএম সালেহউদ্দিন মনে করেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায়ই গণপরিবহনে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, এক শ্রেণির মালিক ও শ্রমিক সড়ক পরিবহন খাতকে জিম্মি করে রেখেছে। বিআরটিএ রুট পারমিট দিলেও পরিবহন নেতাদের মোটা অঙ্কের টাকা না দিলে সে রুটে বাস চালানো যাবে না; এটা যেন ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের মতো অলিখিত আইন, যা বাধ্যতামূলক হয়ে আছে। ফলে যখন যে দল সরকারে আসে চাঁদার নিয়ন্ত্রণ সেই দলের পরিবহন-সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও ক্যাডারদের হাতেই থাকে। তারা পরিবহন খাতকে জিম্মি করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নেন। যার প্রভাব পড়ে রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের ওপর। তাই গণপরিহনে নৈরাজ্য দূর করে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারকে আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক পরিচালক সালেহউদ্দিন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি একেবারে হয় না, এ কথা বলা যাবে না। সমিতির জন্য প্রতি গাড়িতে চাঁদা নির্ধারণ করা আছে। ওই চাঁদার বাইরে সমিতি কোনো টাকা নেয় না। এর বাইরে কোথাও অভিযোগ উঠলেই আমরা অ্যাকশনে যাই। তবে চাঁদার টাকা কোথায় ব্যয় হয় তার সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি এই পরিবহন নেতা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads