• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

হাস্যরস

অবিনির্মাণ, ফ্রস্ট ও শামসুর রাহমান

  • মাসুদুজ্জামান
  • প্রকাশিত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অন্য সাহিত্যভাবুকেরা যেভাবে ভাবেন, জোনাথান কালার ভাবেন আরেকটু ঘুরিয়ে। আমরা যাকে ‘সাহিত্যতত্ত্ব’ বলি, কালার একেই চিহ্নিত করেছেন ‘তত্ত্বে-সাহিত্য’ বলে; সাহিত্যতত্ত্ব নয়। অর্থাৎ তিনি মনে করেন তত্ত্বে একটা বড় জায়গা করে নিয়েছে সাহিত্য। কালার, বলা বাহুল্য, এ সময়ের প্রচণ্ড প্রভাবশালী একজন বহুমাত্রিক সাহিত্যভাবুক, যাঁর চিন্তাটাই বহুবর্ণিল। সাহিত্য নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ভাবনার সূত্রপাত করেছিলেন আরুস্তুতল তার ‘পোয়েটিকস’ গ্রন্থে। এরপর দেশে দেশে আবির্ভাব ঘটেছে অসংখ্য সাহিত্যভাবুকের। সাহিত্যতত্ত্বের। গত শতকের ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাক দেরিদার এরকমই একটা ভাবনা রীতিমতো ঝড় তুলেছিল। সেই ভাবনা বা তত্ত্বটাকে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে ‘ডিকন্সট্রাকশন’। কিন্তু এর বঙ্গীকরণটা কী হবে! গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক একটা বাংলা প্রবন্ধে এর ভাষান্তর করেছেন ‘অবিনির্মাণ’ বলে, যার অর্থ হচ্ছে ‘বিশেষরূপে নির্মাণ’ অর্থাৎ অবিনির্মাণ। দেরিদার ‘অবিনির্মাণ’ বলতে কী বোঝায়, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন গায়ত্রী।            

অবিনির্মাণ সম্পর্কে যে কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে, এটা কোনো তত্ত্ব নয়। কথাটা স্পষ্ট করেই বলেছেন দেরিদা। তত্ত্ব যদি না হয় তাহলে এটা কী? দেরিদা বলছেন, এটা হচ্ছে কোনো টেক্সট বা রচনার অর্থোদ্ধার। কোনো লেখাকে ঘিরে বিশ্লেষণের কিছু বা একগুচ্ছ সূত্র তুলে ধরা। তবে অবিনির্মাণ কোনো দর্শন নয়। তত্ত্বের কোনো স্কুল বা ঘরানারও প্রবর্তন করেননি দেরিদা। দেরিদা নিজেই বলেছেন, অবিনির্মাণ হচ্ছে একধরনের ‘কৌশল, পাঠ-ব্যাখ্যা-লেখার কিছু সূত্রনির্দেশ’ করা। সাধারণত মানুষ কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার সময় বিপরীতধর্মী (বাইনারি অপজিশন) কিছু শব্দ বা অনুষঙ্গ ধরে তার ব্যাখ্যা করে। যেমন ‘পুরুষে’র ব্যাখ্যা পাই ‘নারী’র বিপরীত ভাবলে। দিনের বিপরীত অনুষঙ্গ হিসেবে পাই রাতের অর্থ। অবিনির্মাণ বলতে আরেকটা কথা বলেছেন দেরিদা। অবিনির্মাণ দেখে একটি টেক্সট কোথায় স্ববিরোধী হয়ে উঠছে, কোথাও পরস্পরবিরোধী অনুষঙ্গ উপস্থাপন করছে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে একটি শব্দ বা শব্দগুচ্ছের একাধিক অর্থ। অবিনির্মাণের মূল কথা হলো এটাই। লেখার স্ববিরোধী অংশগুলোকেই অবিনির্মাণ করে নিতে হবে, অর্থাৎ নির্মাণ-বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে লেখাটির অর্থোদ্ধার করতে হবে। অবিনির্মাণ, তাই বলা যায়, একটা লেখার চুলচেরা বিশ্লেষণ। কোনো নির্দিষ্ট সূত্র, যেমন আধুনিকতা/উত্তর-আধুনিকতা অথবা উপমা/চিত্রকল্প ধরে ব্যাখ্যা নয়।

দেরিদা নিজে টেক্সটকে কীভাবে পড়েন তার একটা সূত্রের কথা বলেছেন, সেটি হচ্ছে দুবার করে পাঠ করা। একবার পড়ে যেতে হবে সনাতন পদ্ধতিতে, দেখতে হবে লেখাটি ঠিক কী অর্থ দিচ্ছে।

রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতার কথাই ধরা যাক। কবিতাটির নাম ঝঃড়ঢ়ঢ়রহম নু ডড়ড়ফং ড়হ ধ ঝহড়ুি ঊাবহরহম, শামসুর রাহমান এর চমৎকার অনুবাদ করেছেন ‘শীত-সন্ধ্যায় বনের কিনারে’। আমি এখানে অনুবাদটি তুলে দিচ্ছি :

এই বন কার আমি জানি ব’লে মনে হয়।/বুঝি বাড়ি তার ঐ গাঁয়ে নিশ্চয়;/জানবে না সে তো দেখছি দাঁড়িয়ে আমি/বন তার হলো এখন তুষারময়।/ঘোড়াটা ভাবছে ব্যাপার চমৎকার!/খামার ছাড়াই কী যে লাভ থামবার,/বন আর এই জমাট হ্রদের মাঝে/আজকে সন্ধ্যা সবচে’ অন্ধকার।/ভুল হয়ে গেছে ভেবে সে শব্দ ক’রে/নাড়ার ঘুণ্টি, এবং বনের ’পরে/শুধু আরেকটি শব্দ যাচ্ছে শোনা :/হালকা বাতাসে বরফের কুচি ঝরে।/কাজল গভীর এ-বন মধুর লাগে,/কিন্তু আমার ঢের কাজ বাকী আছে।/যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে,/যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে।

প্রথম পাঠে মনে হবে, কবিতাটির বর্ণনাকারী প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে শান্তি পেতে চাইছে। সৌন্দর্যের কথাও আছে। আদিমতার সঙ্গে যুক্ত হলে ওই সৌন্দর্যকে অনুধাবন করা যায়। প্রথম তিনটি স্তবকে কোলাহলের পরিবর্তে নৈঃশব্দ্যের, সভ্যতার পরিবর্তে প্রকৃতির, গোষ্ঠীর পরিবর্তে একাকিত্বের প্রাধান্য।

দ্বিতীয় পাঠে দেখা যাবে, যে-শব্দগুলো কবিতার শুরু থেকেই প্রাধান্য পেয়ে আসছিল, শেষের দিকে এসে ভ্রমণকারী যখন তার ভ্রমণ অব্যাহত রাখার কথা বলছে, তখনই হঠাৎ তা পাল্টে যাচ্ছে। এভাবেই স্ববিরোধিতার সূত্রে কবিতাটির আরেকটি পাঠ পাওয়া যায়। ফ্রস্টের এই কবিতার মধ্যেও এমন কিছু শব্দ ব্যবহূত হয়েছে, যাদের মধ্যে ভাবের দূরত্ব অনেক বেশি। ফ্রস্ট বনের বর্ণনা প্রসঙ্গে এরকম কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন : ষড়াবষু, ফধৎশ, ফববঢ়। শামসুর রাহমান এর অনুবাদ করেছেন :  কাজল গভীর মধুর। এই অনুবাদটি যথার্থ হয়নি। অনুবাদটি হওয়া উচিত ছিল এরকম : সুন্দর, ঘনকালো, গভীর। ‘সুন্দর’ এখানে নান্দনিক আনন্দকে প্রকাশ করে, কিন্তু পরের দুটি শব্দ (‘ঘনকালো’, ‘গভীর’) আতঙ্ক এবং রহস্যময়তাকে প্রাধান্য দেয়। সার্বিকভাবে পাঠকের যে অনুভূতি জাগে তা হলো বন আজ বিলুপ্তি বা ধ্বংসের মুখে। বনের বুঝি কোনো স্থায়ী, স্থির, সুনির্দিষ্ট সত্তা নেই। ব্যবহূত শব্দের অন্তর্লীন স্ববিরোধকে শনাক্তকরণ করার মধ্য দিয়ে কবিতাটির এরকম অর্থ করা যায় :

দেরিদা বলেছেন, বিপরীত যুগ্মতাকে (বিপরীত শব্দ) যদি উল্টে দেওয়া হয়, যেমন ‘উপস্থিতি’/ ‘অনুপস্থিতি’ তখন হবে ‘অনুপস্থিতি’/ ‘উপস্থিতি’। অনুপস্থিতি তখন প্রাধান্যের জায়গায় চলে আসবে। পাঠক কোনো রচনাকে এভাবে আরো একবার অবিনির্মাণ করে নিতে পারবেন। ‘শীত-সন্ধ্যায় বনের কিনারে’র বর্ণনাকারীর কথা এই কবিতায় অনুপস্থিত। কিন্তু তার ভাবনা আভাসিত হয়েছে ঘোড়ার ঘুণ্টির মধ্যে। ঘুণ্টির ধ্বনি (ভাষাগত নয়) বর্ণনাকারীকে মনে করিয়ে দিয়েছে তার দায়বদ্ধতার কথা, জীবনের অনিঃশেষ চলমানতার কথা। ঘোড়াই হয়ে উঠেছে চলমান মানুষ ও সভ্যতার প্রতিনিধি। ফলে কবিতার যিনি বর্ণনাকারী, তিনি সরে যাচ্ছেন কবিতার কেন্দ্র থেকে, ঘোড়াই হয়ে উঠছে কেন্দ্র। কথাকে স্থানচ্যুত করছে ধ্বনি। প্রাণী স্থানচ্যুত করছে মানুষকে। অনুপস্থিতি এভাবেই উপস্থিতির উপরে স্থান করে নেয়। সংক্ষেপে বললে, ফ্রস্টের এই কবিতাটির বর্ণনাকারী বা কথক খুঁজছে একটা কেন্দ্র, অথচ সেই কেন্দ্র কোথাও নেই। শান্তিই হচ্ছে তার আরাধ্য। কিন্তু এই শান্তিকে সে কাজ দিয়ে, কর্তব্যপরায়ণতা দিয়ে স্থানচ্যুত করছে। সঙ্গতি যদিও তার অন্বিষ্ট, কিন্তু তা অনুপস্থিত; শান্তি শুধু মেলে বনের কিনারে পৌঁছে ভাসমান বা চলমান অবস্থায়।

অবিনির্মাণ করে ‘শীত-সন্ধ্যায় বনের কিনারে’ কবিতাটিতে এভাবেই একটি অর্থ নয়, পাওয়া যায় অনেক অর্থ। নানাভাবে কবিতাটি বিশ্লেষণ করা যায় আর কোনো বিশ্লেষণই চূড়ান্ত নয়। নানান পাঠক এর নানান অর্থ করতে পারেন। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads