• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
চাঁদপুরে উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা শুরু

এশিয়ার বিখ্যাত কারুকার্য্য খচিত, দৃষ্টি নন্দন রথটি সাচারকে সারা বাংলাদেশে দিয়েছে বিশেষ পরিচিতি।

ছবি : বাংলাদেশের খবর

সারা দেশ

চাঁদপুরে উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা শুরু

  • মো. মহিউদ্দিন আল আজাদ
  • প্রকাশিত ১৪ জুলাই ২০১৮

চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার সাচার বাজারে রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ রথ। এশিয়ার বিখ্যাত কারুকার্য্য খচিত, দৃষ্টি নন্দন রথটি সাচারকে সারা বাংলাদেশে দিয়েছে বিশেষ পরিচিতি।

শনিবার আষাঢ় মাসে শুক্লা পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে লক্ষাধিক ভক্তবৃন্দ রথটনার মাধ্যমে ১৪১তম রথ যাত্রার শুভ সূচনা শুরু করবে। সাতদিনের মাথায় একই ভাবে উল্টো রথটানার মাধ্যমে রথ উৎসব সমাপ্ত হবে।

সাচার জগন্নাথ ধাম পূজা উদযাপন ও সাংস্কৃতিক সংঘের উদ্যোগে সপ্তাহ ব্যাপী রথ যাত্রা অনুষ্ঠানে ভারতের আগরতলা ও ত্রিপুরা থেকে ভক্তবৃন্দ সমবেত হবে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন পন্যের প্রায় দেড়শতাধিক স্টল ইতিমধ্যে স্থান পেয়েছে ।

রথ যাত্রা সফল করতে ইতিমধ্যে কচুয়া থানা প্রশাসন রথ যাত্রা কমিটির সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। সার্বিক নিরাত্তার জন্য রথ যাত্রায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে। কচুয়া থানার অফিসার ইনচার্জ সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, কচুয়া রথ যাত্রাটি সফল ও সুন্দরভাবে আয়োজন করতে প্রশাসন সাচার জগন্নাথধাম কমিটির সাথে কয়েকবার বৈঠক করা হয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার জন্য আজ শনিবার রথ যাত্রার সময় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। এ ছাড়াও মেলা চলাকালিন সময় উল্টো রথ যাত্রা পর্যন্তও আইনশৃঙ্কলার নিরাপত্তার স্বার্থে অতিরিক্ত পুলিশ থাকবে।

সাচার রথ যাত্রার ইতিহাস:

চাঁদপুর জেলাধীন কচুয়া উপজেলার অর্ন্তগত ১নং সাচার ইউনিয়নের সাচার গ্রামস্থ তৎকালীন হিন্দু জমিদার ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিত্ব স্বর্গীয় গঁঙ্গা গোবিন্দ সেন মহাশয় পারমার্থিক ধনার্জনে ব্যাকুল হয়ে ১২৭৪ বঙ্গাঁব্দে তীর্থ দর্শনের নিমিত্তে ভারতের শ্রীক্ষেত্রে গমন করেন। পাথৈর নিবাসী স্বর্গীয় গোলক চন্দ্র দাস মহাশয় সহ আরো অনেকে তাঁর (সেন মহাশয়ের) সহযাত্রী ছিলেন। গয়া, কাশি ও বৃন্দাবন সহ অনেক র্তীথ পর্যটন শেষে তিনি সর্বশেষ নীলাচলস্থ শ্রীক্ষেত্রে দারুব্রহ্ম শ্রী হরিকে দর্শনের জন্য আসেন। সেখানে জগন্নাথ দেবের কৃপালাভ ও তার মহাপ্রসাদ সেবন করে পার্থিব জগতের সকল পাপ বিমোচন ও পরলৌকিক মুক্তি লাভের মাধ্যমে নিজ জীবন ধন্য করার প্রত্যাশায় সেন মহাশয়ের মন অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠল। তিনি জগন্নাথ দেবের শ্রী বিগ্রহ দর্শনের জন্য শ্রীক্ষেত্রে অবস্থিত জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করলেন কিন্তু বার বার চেষ্টা করেও জগন্নাথ দেবের দর্শন পেলেন না। হয়তো বা ভক্তের ভক্তি নিষ্ঠা পরীক্ষার জন্যই জগন্নাথদেব অপ্রকট রইলেন। জগন্নাথ দেবের দর্শন না পেয়ে সেন মহাশয় তখন অত্যন্ত মর্মাহত হলেন এবং অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী ও ঘৃণ্য পাপী মনে করে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি জগন্নাথের দেখা না পাবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোন অন্ন জল গ্রহন করবেন না। তিনি অনশন করে নিজ দেহ ত্যাগের সংকল্প করলেন। এভাবে তাঁর তিন দিন গত হলো। তাঁর সঙ্গীগন তাঁকে অনেক সান্ত¡না দিলেও তিনি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। অনাহারে অনিন্দ্রায় তিনি মৃত প্রায় হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় একদা রাতে জগন্নাথ দেব কৃপা পরবশ হয়ে স্বপ্নাদেশে সেন মহাশয়কে বললেন যে, ‘‘আমাকে যে ভক্ত ভক্তি ভরে ডাকে আমি যে তার হয়ে যাই। আমার ভক্তকে আমি কখনো ছেড়ে যেতে পারিনা। তুমি শান্ত হও। তুমি স্বপ্নে আমার যে রূপ দর্শন করলে আমি সেরূপেই তোমার নিজ নিবাস সাচারে আবির্ভূত হবো। তুমি বাড়ী ফিরে গিয়ে আমার শ্রী মূর্তি গঠন করবে। আমি সাচারে দারুব্রহ্মরূপে প্রকাশিত হবো।’’ এভাবে জগন্নাথ দেব স্বপ্নে সেন মহাশয়কে সান্ত¡না দেন। জগন্নাথ দেবের শুভাদেশ পেয়ে প্রফুল্ল চিত্তে দেশে ফিরে এসে সেন মহাশয় এ শুভ সংবাদটি সাচার বাসীকে জানান এবং জগন্নাথদেবের শ্রী বিগ্রহ বিনির্মাণের জন্য সাচার গ্রামের রামকান্ত সূত্রধরকে বলেন। রামকান্ত সূত্রধর শ্রী বিগ্রহ নির্মাণে অপারগতা প্রকাশ করলে চাঁদপুর জেলাধীন মতলব উপজেলার অন্তর্গত বোয়ালিয়া গ্রামের সুদক্ষ কারিগর শ্রী কৃষ্ণকান্ত সূত্রধরকে আনা হয়। অতঃপর কৃষ্ণকান্ত সূত্রধর অত্যন্ত সুনিপুণভাবে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ও সুদর্শনের শ্রীবিগ্রহ নির্মাণ করেন। গঙ্গা গোবিন্দ সেন মহাশয় শ্রী বিগ্রহ নির্মাণের পাশাপাশি মন্দির নির্মাণের কাজও যথা সময়ে সম্পন্ন করেন।

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্নভাবে উদ্যাপনের জন্য সেন মহাশয় শ্রী রথ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিভিন্ন এলাকার সু-দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং কারুকার্যে সুনিপুণ সূত্রধর গণকে আহবান করেন। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ৫ জন শিল্পীকে রথ নির্মাণের দায়িত্ব প্রদান করেন।

শিল্পীগণ হলেন-(১) শ্রী রামকান্ত সূত্রধর (২) শ্রী রামকুমার সূত্রধর (৩) শ্রী কৃষ্ণকান্ত সূত্রধর (৪) শ্রী রামানন্দ সূত্রধর (৫) শ্রী চারু চন্দ্র সূত্রধর। উক্ত শিল্পীগণ নির্ধারিত সময়ে শ্রী রথের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন।

নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে রথ যাত্রার আগের দিন ১২৭৫ বাংলা সনের ১৬ই আষাঢ় শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান সুবিজ্ঞ ব্রাহ্মণ পন্ডিত দ্বারা অত্যন্ত জাঁকজমক পূর্ণ উৎসবের মাধ্যমে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং মহা অভিষেক ক্রিয়া সমাপন করা হয়। তার পর মন্দিরের প্রধান সেবক ভক্ত প্রবর শ্রী নরসিংহ পান্ডা কর্তৃক সর্ব প্রথম যখন পূজা করা হয় তখন তিনি শ্রী বিগ্রহের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তিনি জগন্নাথ দেবের সাক্ষাৎ দর্শন লাভ করেন এবং ঐ দিন অপরাহ্নে কাঁদতে কাঁদতে সেন মহাশয় মন্দিরে প্রবেশ করে শ্রী বিগ্রহের দিকে তাকালে তিনিও জগন্নাথ দেবের সাক্ষাৎ দর্শন লাভ করে কৃতার্থ হন। এভাবে সাচারে জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব ঘটে। এ মহৎকাজের জন্য গঙ্গাঁ গোবিন্দ সেন মহাশয় ভক্ত সমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতি বছর নিয়মিতভাবে আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের ২য়া তিথিতে সাচার জগন্নাথ ধামে রথযাত্রা উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

রথের বৈশিষ্ট্যঃশিল্পীগণ রথের চার পাশের কাঠ খোদাই করে বিভিন্ন দেবদেবী, পশু-পাখি, লতা-পাতা, ফুল-ফল প্রভৃতি দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য খচিত প্রতিকৃতি অংকন করেন। তাছাড়া কলি যুগে যে সকল সামাজিক অনাচার ও ব্যভিচার হচ্ছে বা হবে তার একটি চিত্র উক্ত রথে শিল্পীগণ ফুটিয়ে তুলেছিলেন। যা দেখে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ অত্যন্ত বিমোহিত ও আকৃষ্ট হতেন।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এ যে, আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে বিবেচিত এবং চাঁদপুরের ঐতিহ্য স্বরূপ উক্ত রথটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পুড়ে ফেলে। এর পর ভক্তরা বাঁশের সাহায্যে রথ নির্মাণ করে রথযাত্রা উদযাপন করেন। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে রথটি পুন: নির্মাণ করা হয়। প্রতি বছর রথের দিনে এখানে বিশাল মেলা বসে।

এ মেলায় বাঁশ, বেত ও মাটির তৈরী বিভিন্ন রকমারী সৌখিন সামগ্রী ও কাঠের আসবাবপত্র, লোহা, তামা ও অন্যান্য ধাতু দ্বারা নির্মিত তৈজসপত্র, শিশুদের বিভিন্ন খেলার সরঞ্জাম ইত্যাদি পাওয়া যায়। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার অলংকার, পূজার সামগ্রী, মনোহারী দ্রব্য, হিন্দু মহিলাদের শঙ্খ, সিঁদুর, মৌসুমী ফল পাওয়া যায়। ফল সমূহের মধ্যে- আম, কাঁঠাল, আনারস, ও লটকন প্রচুর পরিমানে কেনা বেচা হয়। তাছাড়া ফলদ ও বনজ বৃক্ষের চারা পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads