• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
মা ইলিশ রক্ষার চেষ্টা বিফলে

নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সুযোগে চাঁদপুরে চলছে ইলিশ নিধন

ছবি - বাংলাদেশের খবর

সারা দেশ

সেনা মোতায়েনের দাবি

মা ইলিশ রক্ষার চেষ্টা বিফলে

  • নাজমুল হুসাইন ও তপু রায়হান
  • প্রকাশিত ১৪ অক্টোবর ২০১৮

প্রধান প্রজনন মৌসুমে ‘মা ইলিশ’ রক্ষায় গত ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশেই ইলিশ শিকার, পরিবহন, মজুত ও কেনা-বেচা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সরকারের এই নিষেধাজ্ঞাকে কার্যত বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছেন জেলে, ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা। বৈরী আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে প্রধান বিচরণক্ষেত্রগুলোতেই ইলিশ শিকারে নেমেছে জেলেরা। নৌকা থেকেই নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে সেগুলো ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর কম দামে পেয়ে সেগুলো লুফে নিচ্ছেন ‘লোভী’ ভোক্তারা। নিষিদ্ধকালের বাকি কয়দিনও এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী মৌসুমে দেশে আবার ইলিশের ‘আকাল’ দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন মৎস্য কর্মকর্তারা। এই অবস্থায় মা ইলিশ বাঁচাতে বাকি কয়দিন প্রজনন এলাকায় সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন তারা।

গত কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে গত ৭ অক্টোবর থেকে দেশে ইলিশ শিকার, পরিবহন, মজুত ও কেনা-বেচা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও লুকিয়ে-ছাপিয়ে হরদম চলছে ধরা ও বেচা-কেনা। চলতি বছর ইলিশ সংরক্ষণের এই পদক্ষেপের অবস্থা অনেকইটা নাজুক। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের দাবি, এ বছরের নিষধাজ্ঞা সফল করতে তদারকি ব্যবস্থা আগের থেকে যথেষ্ট জোরদার করা হয়েছে। কেউ সেটা অমান্য করলে তাকে ধরা হচ্ছে, জেল দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের খবরকে তিনি জানান, এ কার্যক্রম সফল করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বেশ তৎপর রয়েছে। ঢাকা থেকে ৬০ জন কর্মকর্তা ইলিশ প্রজনন এলাকায় পাঠানো হয়েছে। ইলিশের বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

এদিকে চলতি বছর ইলিশ সংরক্ষণের পদক্ষেপের নাজুক অবস্থার কথা স্বীকার করেছেন ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান সমন্বয়ে গঠিত ‘কেন্দ্রীয় মনিটরিং কমিটি’। কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী মৎস্য অধিদফতরের উপপরিচালক মনোয়ার হোসেন বলেন, অন্য যেকোনো বছরের থেকে এবার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইলিশ আহরণ বেশি হচ্ছে— এটা অস্বীকার করা যাবে না। আসলে নদীতে এখন প্রচুর ইলিশ মিলছে। যে কারণে জেলেরা কোনো নিষেধাজ্ঞাই মানছে না। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় তিতলির সুযোগ নিয়ে ইলিশ শিকারে নেমে পড়ছে তারা। তবে তিনি দাবি করেন, ঘূর্ণিঝড় কেটে গেলে এ সমস্যা আর থাকবে না। বর্তমানে নৌবাহিনী, নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড ও র্যাবের সমন্বয়ে জেলায় প্রশাসকরা তদারকি করছেন। দরকার হলে বিমান বাহিনী ও বিজিবি’কে এ জন্য মাঠে নামানো হবে।

নিষেধাজ্ঞা কার্যক্রম সফল করতে ইতোমধ্যে সারা দেশে জেলেদের মধ্যে ভিজিএফের চাল বিতরণ শুরু হয়েছে। মৎস্য অধিদফতরের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মাসুদ আরা মমি জানিয়েছেন, এবার ৩৭ জেলার ৭ লাখ ৭ হাজার ৮৪৭ জেলেকে আগে ভাগেই ভিজিএফের চাল দেওয়া হচ্ছে।

তবে স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, এই সময়টায় তালিকাভুক্ত জেলেদের প্রণোদনা দিতে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়ার পরও যথাযথ তদারকির অভাবে কার্যত সব চেষ্টাই বিফলে যাওয়ার পথে। নিষেধাজ্ঞা কালেও বিভিন্ন এলাকায় ধুম লেগেছে ইলিশ শিকার, বিক্রি ও খাওয়ার। বাংলাদেশের খবরের প্রতিনিধিদের পাঠানো এই সংক্রান্ত খবরগুলোয় উঠে এসেছে ইলিশ নিধনের সেই চিত্র।

১০০ টাকা কেজিতে ইলিশ!

প্রকাশ্য দিবালোকেই ইলিশ শিকার চলছে শরীয়তপুরের পদ্মা নদীতে। জেলার জাজিরা, নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে কারেন্ট জাল দিয়ে ইলিশ শিকার করছে জেলেরা। সেসব ইলিশ কেনার জন্য হাজার হাজার মানুষ ভিড় করছেন নদীপাড়ে। কে কার আগে কিনবে তা নিয়ে লেগে যায় হুড়োহুড়ি। উৎসবের আমেজে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো। জেলা মৎস্য বিভাগ বলছে, একদিকে অভিযানে নামলে অপর দিকে শিকারে নামে জেলেরা। লোকবল কম থাকায় সব তদারকি করা যায় না।

অলিতে-গলিতে ইলিশ; নৌকাপ্রতি চাঁদা নিচ্ছে পুলিশ!

চাঁদপুর প্রশাসন প্রতিদিন নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারী জেলেদের জেল-জরিমানা করছে। তারপরও রাতে ও ভোরে জেলেরা ইলিশ ধরার উৎসবে মেতে উঠেছে। জেলার হরিণা এলাকার অলিতে-গলিতে কম দামে মিলছে মা ইলিশ। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশই নৌকাপ্রতি এক থেকে দুই হাজার টাকা নিচ্ছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আসাদুল বাকী বলেন, আপ্রাণ চেষ্টা করেও মা ইলিশ নিধন থামানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, জেলেরা মা ইলিশ ধরে নিজের পেটে নিজেই লাথি মারছে। এ ছাড়া ক্রেতাদের লোভী মানসিকতাও এর জন্য দায়ী। সেনাবাহিনী মোতায়েন ছাড়া মা ইলিশ রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। তার মতে এভাবে চলতে থাকলে আগামী মৌসুমে দেশে ইলিশ আবারো দুর্লভ হয়ে উঠবে।

ফোনে ফোনেই বিক্রি হচ্ছে ইলিশ!

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ঝালকাঠির নলছিটিতে চলছে মা ইলিশ নিধনের মহোৎসব। সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে স্থানীয় দুই শতাধিক জেলে দিনরাত ইলিশ শিকার করছেন। সেগুলো বিক্রিও হচ্ছে প্রকাশ্যে। আবার কিছু মাছ বিক্রি হচ্ছে ফোনে ফোনে। ব্যাগে অথবা বিভিন্ন কার্টনে করে বুকিং দেওয়া ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ইলিশ। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিগত বছরগুলোয় যেভাবে অভিযান পরিচালিত হতো, এ বছর তেমনটা হচ্ছে না। এবার জেলেরা অভিযানের খবর আগেভাগেই পেয়ে যায়। ফলে অভিযানে সফলতা আসছে না।

স্কুল ও ট্রাভেল ব্যাগে ইলিশ!

প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পদ্মা ও যমুনা নদীতে ইলিশ শিকার করছে মানিকগঞ্জের লোভী জেলেরা। আর এই ইলিশগুলো বিক্রি ও বহনে তারা নানান কৌশল অবলম্বন করছে। শুক্রবার অভিনব কায়দায় ইলিশ বহনের সময় শিবালয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেহেদী হাসান বিপুল পরিমাণ ইলিশ জব্দ করেন। ওই দিন শিবালয় উপজেলার আলোকদিয়া চরাঞ্চলে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। তখন একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তল্লাশি চালিয়ে যাত্রীবেশী ক্রেতাদের কাছে থাকা স্কুলব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগ, কাপড় ও ছালার বস্তাসহ ১০টি পাত্রে রাখা প্রায় ২০০ কেজি ইলিশ জব্দ করা হয়। এ সময় পাঁচ জেলেকে জেল জরিমানা করা হয়।

অনুদানের পরও ইলিশ শিকার!

ইলিশের প্রজনন মৌসুমের ২২ দিন সরকার ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করে জেলেদের জন্য বিশেষ ভিজিএফের ব্যবস্থা করলেও নদীতে জাল ফেলছেন পটুয়াখালীর জেলেরা। শিকার করছেন ইলিশ। আর এসব মাছ কৌশলে গ্রামে গ্রামে কেনা-বেচা হচ্ছে। এ বিষয়ে জেলেদের বক্তব্য, তাদের সংসারে এখন চরম সঙ্কট। সঙ্কট দূর করতে মাঝে মাঝে দিন ও রাতের আঁধারে নদীতে জাল ফেলছেন তারা। তাদের অভিযোগ, তাদের চাল পাওয়ার কথা থাকলেও সেগুলো এখনো পাচ্ছেন না তারা। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন জানান, জেলায় ৬৯ হাজার ৬৬০ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৫ হাজার ৬৪২ জেলের জন্য ২০ কেজি করে চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, একটি ইলিশ একসঙ্গে কমপক্ষে ৩ লাখ ও সর্বোচ্চ ২১ লাখ ডিম ছাড়ে। এসব ডিমের ৭০-৮০ শতাংশ ফুটে রেণু ইলিশ হয়। এর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে, যা পরবর্তীতে ইলিশে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু অযাচিত হারে মা ইলিশ নিধন ও জাটকা নিধনের কারণে গেল শতকের শেষ দশকের আগে যেখানে দেশে উৎপাদিত মোট মাছের ২০ শতাংশই ছিল ইলিশ সেখানে চলতি শতকের প্রথম দশকে মাত্র ৮ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। তবে ২০০৩-০৪ সালের পর থেকে জাটকা ধরা ও মা ইলিশ নিধনে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে মাত্র এক দশকের ব্যবধানেই উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ হয়। ২০০৩ সালে যেখানে এক লাখ ৮০ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয় সেখানে ২০১৭ সালে তা চার লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। আর চলতি ২০১৮ সালে প্রায় পাঁচ লাখ টন ইলিশ উৎপাদনের আশা করছে মৎস্য অধিদফতর। সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য চলতি বছর থেকে সরকার চার বছর মেয়াদি হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। উৎপাদন বৃদ্ধির পরিবর্তে আগামী মৌসুমে ইলিশের আকালের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads