• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
অস্তিত্ব সঙ্কটে বেদে সম্প্রদায়

বেদে সম্প্রদায়

ছবি : কালীগঞ্জ প্রতিনিধি

সারা দেশ

অস্তিত্ব সঙ্কটে বেদে সম্প্রদায়

  • রফিক সরকার, কালীগঞ্জ
  • প্রকাশিত ২১ অক্টোবর ২০১৮

‘ও রানি মা সালাম বারে বার, নামটি আমার জোছনা বানু, রানি থাকি লক্ষ্যার পাড়’ গানটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম ব্যবসাসফল ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমার। আর তাতে প্রয়াত চিত্রপরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল বেদে সম্প্রদায় এবং তাদের জীবনচিত্রই তুলে ধরেছেন। একটা সময় ছিল, যখন সাপের গল্প নিয়ে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও বাংলা সাহিত্যে বেদে সম্প্রদায়ের কাহিনী খুব বড় স্থান দখল করে রয়েছে।

বেদে নারীর তীব্র টানে বিবাগী হয়েছে কতশত পুরুষ। সভ্যতার প্রতি একধরনের নিরাসক্তি রয়েছে তাদের। নিজের কাজটাকে ভালোবাসে, ভালোবাসে মানুষকে আনন্দ দিতে। নিজেদের জন্য বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা ছাড়া আর কোনো চাহিদা যেন নেই। আমাদের কাছে এই সভ্যতা, এই জীবন কখনো যুদ্ধের নামান্তর হতে পারে। কিন্তু বেদে সম্প্রদায়ের কাছে জীবন যেন নদীর স্রোতের মতোই বয়ে চলার অপর নাম। নদীর স্রোতের মতো, বহমান বাতাসের মতো তাদের জীবন।

মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর এক প্রাণী সাপ। সেই সাপই বেদে সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে জীবনধারণের অবলম্বন। সাপের খেলা দেখিয়েই তাদের উপার্জন, পরিবারের ভরণপোষণ। এই ভয়ঙ্কর-সুন্দর বিষধর প্রাণী যাদের হাতে খেলনা হয়ে ওঠে তাদের কাছে জীবনযাপন তো খুব সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু তেমনটা হয়নি। বরং জীবনযাপন খুব কঠিন হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। আধুনিক যুগে সাপের খেলা দেখিয়ে আর জীবন চলে না বেদে সম্প্রদায়ের।

বেদেরা বাংলাদেশের অন্যতম সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৭ লাখ বেদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সাপের ছোবল সামলানোর কৌশল রপ্ত করলেও বেদেরা ‘সভ্যতার’ ছোবল থেকে বাঁচতে পারছে না। তারা আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে। গাজীপুর কালীগঞ্জের নাগরী এলাকা ঘুরে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের দুর্দশার নির্মম উপাখ্যান। উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের কাকালিয়ার টেকের বালু নদীতে ৫০টি নৌকায় ৫০টি পরিবারের চার শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু বেদের বসবাস। এদের মধ্যে আবার তিন শতাধিক ভোটার। ওই টেকের ৫১ শতাংশ জমির মধ্যে ৬ শতাংশ জমিতে তাদের কবরস্থান। আর ৩১ শতাংশ জমিতে থাকে গাদাগাদি করে। কিন্তু সেটারও আবার দাবিদার অন্যলোক। আর এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। মোট জনসংখ্যার ভিজিবি কার্ডধারী ৭ জন। বয়স্ক ভাতা পায় ১৪ জন। বেদে তাদের আদি পেশা। কিন্তু বর্তমানে ১৫-২০ জন বেদে পোশাক কারখানায় কাজ করছে। বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ১৫টি মিটার প্রক্রিয়াধীন। পূর্বে এই বেদেপল্লীতে শিক্ষার হার না থাকলেও বর্তমানে কিছু কিছু বেদে পরিবার শিক্ষামুখী হচ্ছে। এদের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ২০ জন, মাধ্যমিকে ৭ জন ও উচ্চ মাধ্যমিকে ২ জন। এদের তৈরি নৌকার টং ঘরগুলোর অবস্থা ভালো নয়। রান্নার কিছু পাতিল, বাসন, কিছু কাপড়চোপড়, কয়েকটি বাক্সে সাপ, কিছু জড়িবুটি, গাছগাছড়ার শিকড় এই হচ্ছে তাদের সম্পদ, আয়ের উৎস। দিন আনা দিন খাওয়া জীবন। যারা নৌকা নিয়ে ঘোরে তাদের সেইসব ছোট ছোট নৌকাই হচ্ছে ঘর। টং ঘরের মতো। ভেতরের চিত্রও একই।

সংসার চালাতে না পারার আক্ষেপ কাকালিয়া গ্রামের প্রায় সব বেদে পরিবারের। কাকালিয়াতে বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় চার পুরুষের বাস। জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার পরিবারগুলো দেশের অন্য পরিবারগুলোর তুলনায় কিছুটা সচ্ছল। অনেকে বেশ ধনীও হয়েছে। তবে সেখানকার সর্দার আব্বাস উদ্দিন বললেন, বেদে সম্প্রদায়ের পরিবাররা সাপখেলা দেখিয়ে সংসার চালাতে পারছে না। সরকারের সহযোগিতা না পেলে একদিন বেদে সম্প্রদায় বিলীন হয়ে যাবে।

সর্দারের স্ত্রী হালিমা বেগম বললেন, ‘সরকার যদি আমাদের ব্যবসার জন্য ঋণ দিত তাহলে ব্যবসা করে আমরা সংসার চালাতে পারতাম’। তাছাড়া সুবিধাবঞ্চিত বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের সরকারের পক্ষ থেকে ঘর বরাদ্দ দেওয়ারও দাবি জানান তিনি। কাকালিয়া গ্রামের বেদেপল্লীর বেদেরা জানালেন, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য এলাকার জনপ্রতিনিধিরা তাদের নামের তালিকা নিয়েছেন। কিন্তু তুলনামূলকভাবে বিত্তশালী অনেকে বরাদ্দ পেলেও বেদেরা এই সুযোগ পাননি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads