• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
প্রমত্তা তিস্তা এখন মরুভূমি

পানির অভাবে বালু চরে নৌকা। পাশেই সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ

ছবি : বাংলাদেশের খবর

সারা দেশ

প্রমত্তা তিস্তা এখন মরুভূমি

  • এসকে সাহেদ, লালমনিরহাট
  • প্রকাশিত ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

বর্ষায় ফুলে ফেঁপে যাওয়া খরস্রোতা প্রমত্তা তিস্তা এখন প্রায় মরুভূমি। কর্মহীন হয়ে পড়েছে তিস্তাপাড়ের জেলে ও কৃষকরা। চার হাজার কিউসেকের নিচে চলে গেছে এ নদীর পানি। এ অবস্থায়  আজ রোববার থেকে শুরু হচ্ছে তিস্তা ব্যারাজের সেচকাজ। ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে তিস্তার বাংলাদেশ অংশের ১২৫ কিলোমিটার এখন ধু-ধু বালুচর। তিস্তা অববাহিকায় হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। নদীশাসন ও পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় তিস্তা নদী কৃষকের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী নীলফামারী জেলার সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ঐতিহাসিক এ নদী দীর্ঘ ৩১৫ কিলোমিটার। লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে এই নদীটি প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারত গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। যার প্রভাব পড়েছে আমাদের বাংলাদেশ অংশে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তার পরই বাংলাদেশকে পানি দেয় ভারত। তাই বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় এদেশে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ বন্যা। শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা অনুসারে পানির অভাবে তিস্তা পরিনত হয় মরুভুমিতে। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বঞ্চিত এদেশে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হলেও সুফল মেলেনি।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ পানির অভাবে অকার্যকর হওয়ার উপক্রম। গত কয়েক দিন থেকে তিস্তার পানি ব্যারাজ পয়েন্টে ৪ হাজার কিউসেকের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই স্বল্প পানির ওপর ভর করেই আজ রোববার তিস্তা ব্যারাজের সেচকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে,  যার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

নদীতে দিনভর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা জেলেরা কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। হেঁটেই তিস্তা পাড়ি দেওয়া যায় বলে খেয়াঘাটের মাঝিদের নৌকা এখন শুকনো চালুচরে পড়ে আছে। বেকার ও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা। অনেকেই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। পানির অভাবে মরে যাচ্ছে গাছপালা। তিস্তাপাড়ের বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখিও চলে যাচ্ছে অন্যত্র। প্রায় বিলুপ্তির পথে নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ।

নদীতে তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়ক সেতু ও গঙ্গাচড়া শেখ হাসিনা সেতু থাকলেও হেঁটেই পার হচ্ছেন অনেকে। তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরের বালুতে ভুট্টা, আলুসহ বিভিন্ন সবজির চাষাবাদ হলেও সেচের অভাবে মরে যাচ্ছে। ফলে কৃষকদের সেচকাজে শ্রম দিয়ে চাষাবাদ করতে দেখা গেছে।

তিস্তাপাড়ের জেলে আবদুল করিম জানান, স্ত্রী ও দুই সন্ত্তান নিয়ে তার সংসার চলে তিস্তায় দিনভর মাছ ধরে। এখন পানি না থাকায় মাছ কম, তাই আয়ও কম। বর্ষাকালে বেরালী, আইর ও বোয়াল মাছ পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। আগে ৪০০-৫০০ টাকা আয় হলেও এখন সামান্য পানিতে জাল বেয়ে আসছে মাত্র ১৫০-২০০ টাকার মাছ, যা দিয়ে দিন কাটছে কষ্টে।

নৌকার মাঝি আবুল কালাম জানান, বর্ষাকালে খেয়া পারাপারে ও জেলেদের নৌকা ভাড়া দিয়ে দৈনিক ৫০০-৬০০ টাকা আয় হতো। কিন্তু এখন পানিশূন্য তিস্তায় নৌকা চলে না। তাই তিস্তা ব্যারাজে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নৌ-ভ্রমণের আনন্দ দিয়ে ২০০-৩০০ টাকা আয়ে কোনোমতে সংসার চলছে।

তিস্তাপাড়ের কৃষক কাজল মিয়া, আবুল হোসেন ও কৃষানী মালেকা খাতুন জানান, বর্ষাকালে উজান থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি আসায় ভয়াবহ বন্যায় ফসলের ক্ষতিসহ নদী ভাঙনে ঘরবাড়িহারা হন এ অঞ্চলের মানুষ। আবার শুষ্ক মৌসুমে ফসল রক্ষার প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না। ফলে নষ্ট হয় তিস্তা অববাহিকায় আবাদ যোগ্য সবজিসহ বিভিন্ন ফসল।

তিস্তাপাড়ের স্কুল শিক্ষক আবদুল গফুর জানান, প্রমত্তা তিস্তা নদীর বুকে ছুটে চলা জেলে-মাঝিমাল্লাদের নেই আগের মতো কর্মব্যস্ততা। থমকে গেছে তিস্তাপাড়ের জেলে-মাঝি পরিবারের উপার্জন। মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন বিস্তীর্ণ জনপদের লাখো মানুষ। অথচ পানিপ্রবাহ সচল ও নদীশাসন হলে তিস্তার দুই তীরে ফসলের বিপ্লব ঘটবে। ফিরে আসবে তিস্তার হারানো যৌবন।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, রোববার সকাল থেকে তিস্তা ব্যারাজের সেচকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার কিউসেক পানি রয়েছে। ওই পানিতে সিলড্রাপ ও ক্যানেলগুলো ভরে রাখা হয়েছে। যদি আরো পানি কমে যায় তাহলে সেচ প্রকল্প সচল রাখাই কষ্টকর হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads