• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
জঙ্গি হবে না এক টাকার মাস্টারের ছাত্ররা

এক টাকার মাস্টার লুৎফর রহমান

ছবি : বাংলাদেশের খবর

সারা দেশ

জঙ্গি হবে না এক টাকার মাস্টারের ছাত্ররা

  • গাইবান্ধা প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২০ জানুয়ারি ২০১৯

আসল নাম লুৎফর রহমান। ১৯৭৪ সালে ব্রহ্মপুত্র কেড়ে নেয় তার বাড়িঘর-জমিজমা। তারপর আশ্রয় নেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধে। এখনো সেখানেই বসবাস করছেন তিনি। আছে স্ত্রী ও দুই ছেলে। সহায় সম্বলহীন লুৎফর রহমানের কপালে জুটেছে ‘আশ্রিত’ তকমাও। তবে এলাকায় তিনি পরিচিত এক টাকার মাস্টার হিসেবেই।

লুৎফর রহমান একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ। দরিদ্র ও অসহায়দের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে তিনি নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ৬৯ বছর বয়সেও বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে দিনরাত ছুটে বেড়াচ্ছেন। বিনিময়ে তিনি একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দিনে এক টাকা করে নেন। তাই গাইবান্ধা শহর ও গ্রামের মানুষ লুৎফর রহমানকে চেনেন এক টাকার মাস্টার নামেই।

সেই এক টাকার মাস্টার ওই এলাকার মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র। লুৎফর রহমানেরও প্রত্যয় তার ছাত্ররা জঙ্গি হবে না। তারা পড়ালেখা করে অনেক বড় হবে, মানুুষের মতো মানুষ হবে।

লুৎফর রহমান বলেন, জঙ্গিরা দেশের ও মানুষের ক্ষতি করে। আমার ছাত্ররা জঙ্গি হবে না। তারা পড়ালেখা করে অনেক বড় হবে, মানুষ হবে। তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষিত কিছু তরুণ জঙ্গিবাদের মতো বিপথগামী পথে যাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। 

তার মতে, দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়তে শিক্ষার বিকল্প নেই, শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ ও জাতির উন্নতি হতে পারে না। তাই শিক্ষা জাগিয়ে তুলতে এবং জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি শিশুদের পড়ালেখা শেখান।

১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুনভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন লুৎফর রহমান। এরপর আর্থিক অনটনে তার আর পড়ালেখা করা হয়নি। দুই বছরের মাথায় নদীতে ভিটেমাটিসহ সব হারিয়ে সর্বহারা হয়ে যান। এতে মানসিকভাবে ভেঙেও পড়েন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার সেই ধাক্কাটা আজো তার মাঝে বিরাজমান।

লুৎফর রহমান জানান, সব হারিয়ে সদর উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেওয়ার পর চাকরির জন্য কিছুদিন চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু তা জোটেনি। স্বাধীনচেতা বলে পরে চাকরি পেতে তেমন আগ্রহ ছিল না। এ জন্য স্থানীয় বাজারে লন্ড্রি দোকান খুলে বসেন। কিন্তু এখানেও মন বসেনি তার।

কারণ তিনি লক্ষ্য করেছেন ওই এলাকার দরিদ্র মানুষের সন্তানরা টাকার জন্য পড়ালেখা করতে পারছে না। স্কুলে গেলেও পড়ালেখায় এগোতে পারে না। পেটের ভাত জোগাড় করাই দুঃসাধ্য, তার ওপর সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালানো দরিদ্র পরিবারের কাছে অসম্ভব। কেউ কিছুটা পড়ালেখায় এগোতে গিয়েও প্রাইভেট বা কোচিং পড়ার সামর্থ্য না থাকায় ঝরে পড়ছে। তাই চিন্তা করলেন এমন শিশুদের যাতে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে না যায় তার দায়িত্ব নিতে হবে। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। যারা স্কুলে যায়, বা যেতে চায় না তাদের পড়ালেখা করানোর দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন।

বর্তমানে লুৎফর মাস্টার বাগুড়িয়া, মদনের পাড়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্জিপাড়া, পুলবন্দিসহ বেশ কিছু গ্রামে পায়ে হেঁটেই শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

অভিভাবকদের বক্তব্য, তারা গরিব মানুষ। সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে পারেন না। প্রাইভেট মাস্টার বা কোচিং সেন্টারে দিলে ২০ থেকে ৩০০ টাকা দিতে হয়। সে সামর্থ্য নেই। কাজেই এক টাকার মাস্টারই তাদের ভরসা। তবে এক টাকা নেন বলে যে তিনি দায়সারাভাবে পড়ান তা নয়। তিনি বেশ তিনি ভালো পড়ান। যত্ন সহকারে শিক্ষা দেন।

শিশু বয়সে লুৎফর রহমানের কাছে পাঠ নিয়ে এখন যারা প্রতিষ্ঠিত তাদেরও বক্তব্য, এক টাকার মাস্টারের কাছ থেকে শিক্ষার আলো নিয়েই আজ তারা সমাজ, পরিবার ও দেশের জন্য অবদান রাখার সুযোগ পাচ্ছেন।

শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯৮৪ সাল থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ালেখায় সহযোগিতা করছেন লুৎফর রহমান। ১০ থেকে ১২ জনকে একত্র করেন। এভাবে ভাগ ভাগ করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদের পড়াতে শুরু করলেন। সে থেকে দীর্ঘ ৩৫ বছর ওই এলাকার গ্রামগুলোয় শিক্ষার আলো ছড়ানোর বিনিময়ে প্রতি শিক্ষার্থী থেকে দিনে চার আনা (পঁচিশ পয়সা) থেকে শুরু করে বর্তমানে ১ টাকা পর্যন্ত ভাতা গ্রহণ করছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের অনেক পরিবার এক টাকা দেওয়ারও সামর্থ্য রাখেন না, কিন্তু তাদেরও শিক্ষা দেন তিনি। ছড়িয়ে দেন জ্ঞানের আলো। এই এক টাকা নিয়ে বা বিনা পয়সায় পড়িয়ে বর্তমানে মাসে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ভাতা পান লুৎফর মাস্টার। আর তাতেই চলে তার চার মুখের সংসার।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads