• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
জোরালো হচ্ছে ফাঁসির দাবি

মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি

সংরক্ষিত ছবি

সারা দেশ

জোরালো হচ্ছে ফাঁসির দাবি

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ১৩ এপ্রিল ২০১৯

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নির্যাতন ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ফুঁসে উঠছে দেশের মানুষ। গত কয়েক দিন ধরে দেশের সর্বত্রই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নুসরাত হত্যার ঘটনা। হত্যার মূল হোতা মাদরাসা অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীদের ফাঁসির দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ। ফুটপাতের চা দোকান থেকে শুরু করে দেশের অফিস-আদালতে এই একই আলোচনা। সবার দাবি একটাই— মানুষ নামধারী ভণ্ড নরপশু অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার ফাঁসি। এই ঘটনার পর সিরাজ উদ দৌলার নানা অপকর্মের কাহিনী বেরিয়ে আসছে। তার বিরুদ্ধে আগেও মাদরাসাছাত্রকে বলাৎকার করার অভিযোগ ছাড়াও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ আছে। এছাড়া নুসরাতের গায়ে হাত দেওয়ার আগে সে একই মাদরাসার একাধিক ছাত্রীকে কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেছে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি। এখন থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় এই নেতা স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে তার সব অপকর্ম জায়েজ করতে সক্ষম হয়। ‘ম্যানেজ মাস্টার’ বলে পরিচিতি এই জামায়াত নেতা নিজের স্বার্থেই মাদরাসায় একটি ক্যাডার বাহিনী তৈরি করে রেখেছে। কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুললে ওই বাহিনীর সদস্যরা প্রতিবাদকারীকে শায়েস্তা করে। সম্প্রতি এপিবিএনএ প্রত্যাহার হওয়া সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গেও সিরাজ উদ দৌলার সখ্য গড়ে ওঠার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। এ কারণে ওসি আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ না করে থানায় বসিয়ে নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে ওসি নুসরাতকে বিব্রতকর প্রশ্ন করেন। অনেকেই বলছেন, ওসিকে সোনাগাজী থেকে প্রত্যাহারই যথেষ্ট নয়। কারণ প্রত্যাহার কোনো শাস্তি নয়। প্রত্যাহার করে থানা থেকে তাকে এপিবিএনএ বদলি করা হয়েছে মাত্র। বিশ্লেষকদের মতে, আসামিদের পক্ষ নেওয়ার দায়ে ওই ওসিকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

এদিকে গত ৯ এপ্রিল এ-সংক্রান্ত মামলার তদন্ত ভার গ্রহণ করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তারা ইতোমধ্যে সিরাজ উদ দৌলার বেশ কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করেছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মুকসুদুল আলম ও তার সহযোগী সাখাওয়াত হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা দুইজনই নুসরাত হত্যা মামলার আসামি। পিবিআইর ইনস্পেক্টর শাহ আলম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, কাউন্সিলর মুকসুদুল আলমকে ঢাকা থেকে এবং তার সহযোগীকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার মুক্তির দাবিতে সোনাগাজীতে মিছিল করেছিলেন কাউন্সিলর মুকসুদুল।

অন্যদিকে পিবিআইর অপর একটি দল গতকাল শুক্রবার সকালে মামলার আরেক আসামি নুর উদ্দিনকে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে আটক করে।

পিবিআইয়ের একটি সূত্র জানায়, ময়মনসিংহে দুপুরে ভালুকা সিড স্টোর এলাকায় অভিযান চালিয়ে নূর উদ্দিনকে আটক করা হয়। পরে তাকে ফেনীতে পাঠানো হয়। নুসরাত জাহানকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নূর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম সরাসরি জড়িত বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা দুজনই রয়েছেন সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে। এদের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে বলে এলাকার মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ধারণা। নুসরাতকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে করা মামলায় ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার মুক্তির দাবিতে ‘সিরাজ উদ দৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামে কমিটি গঠন করা হয়। ২০ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক নূর উদ্দিন এবং যুগ্ম আহ্বায়ক হন শাহাদাত হোসেন। তাদের নেতৃত্বে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে গত ২৮ ও ৩০ মার্চ উপজেলা সদরে দুই দফা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। তারাই নুসরাতের সমর্থকদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক যা বললেন :  নুসরাতকে পরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক আল মাহমুদ ফায়জুল কবীর। তিনি বলেন, নুসরাতের করা শ্লীলতাহানির অভিযোগ আমলে নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা এড়ানো যেত। গতকাল শুক্রবার সোনাগাজী মাদরাসার অফিস কক্ষে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা যা বললেন : মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা সোনাগাজী থানার ওসি (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন বলেন, তদন্ত চলাকালে আমি মোট ৯ জনকে গ্রেফতার করেছি। এর মধ্যে ৩ জনই এজাহার নামীয়। গত ৯ এপ্রিল নুসরাত হত্যা মামলায় অধ্যক্ষ এএসএম সিরাজ উদ দৌলার শ্যালিকার মেয়ে উম্মে সুলতানা পপি ও যোবায়ের হোসেন নামে অন্য একজনকে গ্রেফতার করা হয়। এ দুইজনকে জিজ্ঞাসাবাদে সাত দিন পুলিশ রিমান্ডের আবেদন জানালে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সরাফ উদ্দিন আহম্মেদ ৫ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। কিন্তু গতকাল ১২ এপ্রিলও তাদের পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয়নি। তারা জেলহাজতেই আছে।

এ প্রসঙ্গে কামাল হোসেন বলেন, যেদিন রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে সেদিনই মামলার তদন্তভার পিবিআই গ্রহণ করেছে। তারাই ওই আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এ প্রশ্নে পিবিআই ফেনী জেলা ইনস্পেক্টর শাহ আলম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরা একের পর অভিযান পরিচালনা করছি। গত ৩ দিনে আমরা বেশ কজন আসামিও গ্রেফতার করেছি। এগুলো প্রসেস করতে সময় লাগছে। আজ-কালের মধ্যে রিমান্ড পাওয়া ২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এছাড়া এর আগে গত ৯ এপ্রিল একই আদালতে নূর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন ও শহিদুল ইসলামকে ৫ দিন করে, পরের দিন ১০ এপ্রিল মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ এএসএম সিরাজ উদ দৌলাকে ৭ দিন, একই মাদরাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আবছার উদ্দিন ও নুসরাতের সহপাঠী আরিফুল ইসলামকে ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদের পিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করছে। জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে বলে দাবি করছে এবং প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরেই মামলার তদন্ত এগোচ্ছে। খুব শিগগিরই এ মামলার রহস্য উদঘাটন করা যাবে বলে দাবি পিবিআই সূত্রের।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এ মামলার তদন্ত, বিচার সবকিছু দ্রুত করা উচিত। যেমন সিলেটের রাজন, খুলনার রাকিব হত্যার বিচার দ্রুত করে আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছিল। একইভাবে বর্বরোচিত এই ঘটনারও দ্রুত বিচার করে রায়ও দ্রুত কার্যকর করা উচিত, যাতে বিকৃত রুচির নরপিশাচরা আর এমন ঘটনা ঘটাতে সাহস না পায়।

উল্লেখ্য, গত ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। মাদরাসার ছাদের ওপরে কাউকে মারধর করা হচ্ছে— ওই মাদরাসার এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে এমন সংবাদ দিলে ভবনের চারতলায় যান নুসরাত। সেখানে মুখোশ পরা ৪-৫ ছাত্রী তাকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তারা গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল বোরকা পরা চারজনসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। পরে মামলার এজাহার পরিবর্তন করে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, পৌর কাউন্সিলর মুকছুদ আলমসহ ৮ জনকে আসামি করা হয়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads